fbpx
বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার

বাংলা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার


যুগে যুগে এই বাংলায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অনেক সময় অনেক জাতির উপনিবেশ ঘটে। কেউ কেউ আবার ব্যবসা বানিজ্যের নাম করে শাসন করেছে এই বাংলা। তবে বাঙ্গালী জাতি প্রাচীন ভারতের একটি পরাক্রমশালী সমুদ্র অভিযাত্রী জাতি ছিল। প্রাচীনকালে ভারতের পূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালী, কলিঙ্গী, তামিল প্রভৃতি জাতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় নানা উপনিবেশ গড়ে তুলতেন। তারা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপে এরকম একটি বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। এটি শ্রী বিজয় সাম্রাজ্য নামে পরিচিত।

ভিয়েতনামের ইতিহাসে উল্লেখ আছে ভারতবর্ষের বন-লাং (বাংলা) নামক দেশ থেকে লাক লোং (লক্ষণ) নামক এক ব্যক্তি ভিয়েতনামে গিয়ে “বন-লাং” নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই বন-লাং যে ভারতবর্ষের বাংলা সে ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই বাঙালীদের রাজ্য খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল।


অপরদিকে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে উল্লেখ আছে বঙ্গ দেশ থেকে আগত বিজয় সিংহ নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় দ্রাবিড় রাজাদের পতন ঘটিয়ে সিংহল (সিংহ বংশীয়) নামে একটি নতুন রাজ্যের পত্তন করেন। বিজয় সিংহকে সিংহলী জাতির পিতা হিসেবে পরিগণিত করা হয়। বিজয় সিংহকে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় একটি মহাকাব্যও রয়েছে যা “মহাবংশ” নামে পরিচিত।

তবে, অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর পূর্বে বাংলা সম্পর্কে কোন ধরনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। ধারণা করা হয় এ সময় বাংলায় ইন্দো-আর্য, দ্রাবিড় ও মঙ্গোলয়েডদের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং তাদেরই মধ্যে একটি সম্প্রদায়ের নাম ছিল বঙ্গ।

কালে কালে যুগে যুগে অনেক শাসক এই বাংলাকে শাসন করে গেছেন। তাদের মধ্যে প্রাচীন কালের প্রাক ঐতিহাসিক যুগে দেখা যায় নন্দ সাম্রাজ্য। নন্দ সাম্রাজ্য ছিল বাংলার ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় যুগ। এই যুগে বাংলার শক্তিমত্তা ও প্রাচুর্য শীর্ষে আরোহণ করে। এই যুগে বাংলা সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়। নন্দ রাজাদের জন্ম হয়েছিল বাংলায়। তারা বাংলা থেকে মগধ (বিহার) দখল করে এবং উভয় রাজ্যকে ঐক্যবদ্ধ করে বঙ্গ-মগধ নামে একটি নতুন সাম্রাজ্যের পত্তন করে। প্রাচীন গ্রিক ইতিহাসে বাংলাকে গঙ্গারিডাই এবং মগধকে প্রাসি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিক ইতিহাসে এই সংযুক্ত রাজ্যকে গঙ্গারিডাই ও প্রাসি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নন্দ সাম্রাজ্য এর পর আসে মৌর্য সাম্রাজ্য। মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসনকালে মহাস্থান (পুণ্ড্রনগর) কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছিল বলে ধারণা করা হয়। তৃতীয় মৌর্য সম্রাট অশোকের ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা শিলালিপি এখানে পাওয়া গিয়েছে। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে (মৌর্য শাসনকালীন গ্রন্থ) বলেছেন, পুণ্ড্রের কৌষেয় বস্ত্র মরকত মণির মতো মসৃণ। একে পৌণ্ড্রিকা বলা হয়েছে। এ ধরনের বস্ত্র শুধু মগধ ও পুণ্ড্রে উৎপন্ন হতো বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ গ্রন্থে বঙ্গের এক প্রকার বস্ত্রকে “বাঙ্গিকা” বলা হয়েছে যা শ্বেত বর্ণের হতো। সর্বোপরি এ গ্রন্থে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের প্রশংসা করা হয়েছে। এরই মধ্য দিয়ে প্রাক-ঐতিহাসিক যুগের সমাপ্তি ঘটে। এর পর আসে ধ্রুপদী যুগ। এ যুগে দেখা যায় গৌড় সাম্রাজ্য, পাল রাজবংশ, সেন রাজবংশ, দেব রাজত্ব।

শুরু হয় মধ্যযুগ এবং ইসলামী শাসন। শুরু হয় খিলজী শাসন। সপ্তম শতাব্দীতে আরব মুসলিম ব্যবসায়ী ও সুফি ধর্মপ্রচারকদের মাধ্যমে বাংলায় প্রথম ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল। দ্বাদশ শতকে মুসলিমরা বাংলায় বিজয় লাভ করে এবং তারা ঐ অঞ্চলে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিল। ১২০২ সালের শুরুর দিকে দিল্লী সালতানাত থেকে একজন সামরিক অধিনায়ক বখতিয়ার খিলজী বাংলা ও বিহারকে পরাজিত করেছিলেন। প্রথমদিকে বাংলা তুর্কী জাতির বিভিন্ন গোত্র দ্বারা শাসিত হয়েছিল। পরবর্তীতে আরব, পারসীয়, আফগান, মুঘল প্রভৃতি অভিযানকারী জাতি দ্বারা বাংলা শাসিত হয়। মুসলিম শাসকদের অধীনে বাংলা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছিল। কারণ শহরগুলো উন্নত হয়েছিল; প্রাসাদ, দুর্গ, মসজিদ, সমাধিসৌধ এবং বাগান; রাস্তা এবং সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল; এবং নতুন বাণিজ্য পথগুলো সমৃদ্ধি ও নতুন সাংস্কৃতিক জীবন বয়ে নিয়ে এসেছিল। বখতিয়ার খিলজীর খিলজী শাসনের পর আসে মামলুক শাসন, মাহমুদ শাহী রাজবংশের শাসন। আরো আসে বাংলা সালতানাত, ইলিয়াস শাহী রাজবংশ। কিন্তু রাজা গণেশ বাংলার এক আমির বায়েজীদ শাহকে ইলিয়াস শাহী বংশের শেষ সুলতানকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করতে উৎসাহিত করেন। পরে বায়েজীদ শাহকে সরিয়ে তিনি নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। পরে সাদী খান ও নাসির খান নামক ক্ষমতা দখলকারী আমীরদের সরিয়ে মাহমুদ শাহ নামক ইলিয়াস শাহী বংশের একজন বংশধর বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। এর ফলে বাংলায় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ জোরদখলকারী হাবশী শাসকদের সরিয়ে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তিনি প্রাথমিক জীবনে আরব দেশের ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশে আগত এক উদ্বাস্তু ছিলেন। পর্যায়ক্রমে পাখতুন শাসন আসে, পরে সূরী রাজবংশ শাসন করে, তারপর কররানী রাজবংশ ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাজ খান কররানী বাংলার দুর্বল সুলতান গিয়াসউদ্দীনকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করেন।

১৫৭৬ সালে মুঘল ও বাঙ্গালী সেনাবাহিনী রাজমহলের প্রান্তরে একটি চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধের প্রথমদিকে বাঙ্গালী বাহিনী বিজয় অর্জন করে। কিন্তু পরবর্তীতে সেনাপতি কতলু খান ও বিক্রমাদিত্য বিশ্বাসঘাতকতা করলে তারা পরাজিত হয়। শুরু হয় মুঘল যুগ। মুর্শিদকুলী খান ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তার সময়ে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলা তুর্কী, পারসী, মাজাপাহী, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরে সিরাজ উদ-দৌলাকে ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত করে প্রায় ২০০ বছর শাসন করে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের পতন ঘটলে বাংলাও দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। পূর্ব বঙ্গ চলে যায় ভারতের কাছে। পশ্চিম বঙ্গের নতুন নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ। মূলত এই উপনিবেশিকতাকে এবং বিভিন্ন জাতির বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ার কারণে এবং সাহিত্যিকদের সাহিত্য চর্চার ভাষার বৈচিত্র্যের কারণে বাংলা ভাষায় অনেক সংস্কৃত ও বিদেশি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে।


বাংলা ভাষা গোড়াপত্তনের যুগে স্বল্প সংখ্যক শব্দ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও নানা ভাষার সংস্পর্শে এসে এর শব্দ ভান্ডার বৃদ্ধি পয়েছে। বাংলাদেশ তুর্কি আগমন ও মুসলিম শাসন পত্তনের সুযোগে ক্রমে প্রচুর আরবি ও ফারসি শব্দ বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়েছে। তেমনি ইংরেজ শাসনামলেও তাদের নিজস্ব সাহিত্য এবং সংস্কৃতির বহু শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করে। বাংলা ভাষার এ শব্দ ভান্ডারকে পণ্ডিতগণ কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছে। যেমন:-
১। তৎসম শব্দ
২। অর্ধ তৎসম শব্দ
৩। তদ্ভব শব্দ
৪। দেশি শব্দ
৫। বিদেশি শব্দ
 
তৎসম শব্দ: যেসব শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে কোনোরকম পরিবর্তিত না হয়ে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং যাদের রূপ অপরিবর্তিত রয়েছে, সেসব শব্দকে তৎসম শব্দ বলা হয়। এটি একটি পারিভাষিক শব্দ। তৎ শব্দের অর্থ তার এবং সম শব্দের অর্থ সমান। অর্থাৎ তৎসম শব্দের অর্থ তার (সংস্কৃত) সমান। যেমন:-
চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, ভবন, ধর্ম, পাত্র, মনুষ্য ইত্যাদি। 

 

বাংলা ভাষায় ব্যবহূত তৎসম শব্দগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়:
সমোচ্চারিত: সমোচ্চারিত শব্দগুলি হুবহু সংস্কৃতের মতো লিখিত ও উচ্চারিত হয়।
যেমন: নারী, নদী, ভ্রাতা, বধূ ইত্যাদি।
অসমোচ্চারিত: অসমোচ্চারিত শব্দগুলি সংস্কৃত অনুযায়ী লিখিত হলেও উচ্চারণে কিছুটা পার্থক্য ঘটে।
যেমন: বৃক্ষ, পদ্ম, ভস্ম ইত্যাদি।
 
অর্ধ-তৎসম শব্দ: বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে ব্যবহৃত হয়। এগুলো অর্ধ-তৎসম শব্দ। অর্ধ-তৎসম মানে আধা সংস্কৃত। যেমন:-
জ্যোছনা, ছেরাদ্দ, গিন্নী, বোষ্টম, কুচ্ছিত-এ শব্দগুলোর সংস্কৃত জ্যোৎস্না, শ্রাদ্ধ, গৃহিণী, বৈষ্ণব, কুৎসিত।
 
তদ্ভব শব্দ: যেসব শব্দের মূল সংস্কৃত ভাষায় পাওয়া যায়, কিন্তু ভাষার স্বাভাবিক বিবর্তন ধারায় প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে, তাই তদ্ভব শব্দ। এটি একটি পারিভাষিক শব্দ। ‘তৎ’ অর্থ তার এবং ভব অর্থ উৎপন্ন। অর্থাৎ তদ্ভব শব্দের অর্থ সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আদি রূপ বৈদিক বা সংস্কৃত। কালে কালে ধ্বনিগত পরিবর্তনের ফলে এ ভাষার অনেক শব্দ প্রাকৃতের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষায় অনুপ্রবেশ করে। পূর্বভারতীয় বাংলা ভাষায়ও এ ধরনের অনেক শব্দ প্রবেশ লাভ করে। বাংলা ভাষার উদ্ভব শব্দগুলো মাগধী প্রাকৃত থেকে এসেছে। যেমন:-
সংস্কৃত প্রাকৃত তদ্ভব
হস্ত হথ হাত
চর্মকার চম্মআর চামার
চন্দ্র চান্দ/চন্দ চাঁদ
দধি দহি দই
বধূ বহু বৌ/বউ
মক্ষিকা মচ্ছিআ/মচ্ছিঅ/মচ্ছি/মাচ্ছি মাছি

এই তদ্ভব শব্দগুলোকে খাঁটি বাংলা শব্দও বলা হয়। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে যে শব্দগুলি ব্যবহূত হয় তার অধিকাংশই তদ্ভব শব্দ। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও খ্যাতনামা লেখকদের রচনার শতকরা ৬০ ভাগ শব্দই তদ্ভব।

দেশি শব্দ: বাংলাদেশের আদিম আধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদান বাংলায় রক্ষিত রয়েছে। এসব শব্দকে দেশি শব্দ নামে অভিহিত করা হয়। অনেক সময় এসব শব্দের মূল নির্ধারণ করা যায় না। কিন্তু কোন ভাষা থেকে এসেছে তার হদিস মেলে।
যেমন:-
কুড়ি (বিশ) – কোলভাষা, পেট (উদর) – তামিল ভাষা, চুলা (উনুন) – মুণ্ডারী ভাষা। তেমনি কলা, গঞ্জ, টোপর, ডাব, ডাগর, ঢেঁকি, কয়লা, কাকা, খবর, খাতা, কামড়, গয়লা, ঢোল, কাঁটা, খোঁপা, খোঁচা, গলা, ডিঙি, কুলা, খোকা, খুকি, বাখারি, কড়ি, চোঙ, চাউল, ছাই, ঝাল, ঝিঙা, ঝোল, ঠাটা, ডাহা, ঢিল, পয়লা,  ডাঙর, খোঁড়া, চোঙা, ছাল, ঢিল, ঝিঙা, মাঠ, মুড়ি, কালা, চাটাই, গোড়া, ধুতি, নেকা, খোঁজ, চিংড়ি, কাতলা, ঝিনুক, মেকি, নেড়া, চুলা, আড্ডা, ঝানু, ঝোপ, ডাঁসা, শিকড়, খেয়া, লাঠি, ডাল, কলকে, ঝাপসা, কচি, ছুটি, ঘুম, দর, গোড়া, গাঁইতি, যাঁতা, চোঙা, খড়, পেট, কুড়ি, দোয়েল, বোবা প্রভৃতি।
 
বিদেশি শব্দ: রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সংস্কৃতিগত ও বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে আগত বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বহু শব্দ বাংলায় এসে স্থান করে নিয়েছে। এসব শব্দকে বিদেশি শব্দ বলা হয়। এসব বিদেশি শব্দের মধ্যে আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি শব্দই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে কালের সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয় উপকরণরূপে বিদেশি শব্দ এ দেশের ভাষায় গৃহীত হয়েছে। এছাড়া পর্তুগিজ, ফরাসি, ওলন্দাজ, তুর্কি-এসব ভাষারও কিছু শব্দ একইভাবে বাংলা ভাষায় এসে গেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, মায়ানমার, মালয়, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশেরও কিছু শব্দ আমাদের ভাষায় প্রচলিত রয়েছে।
আরবি শব্দ আল্লাহ, ইসলাম, ঈমান, ওযু, কলম, কোরবানী, কুরআন, কেয়ামত, শরিফ, গোসল, জান্নাত, জাহান্নাম, তওবা, তসবী, যাকাত, হজ্জ, হাদিস, হারাম, হালাল, মসজিদ, মহরম, মাতব্বর, মাফ, মাল, মালিক, মুনাফা, মুলতবি, মুসলিম, মুসাফির, লেবু, হেফাজত, আদালত, আলেম, ইনসান, ঈদ, উকিল, ওজর, এজলাস, এলেম, কানুন, কলম, কিতাব, কেচ্ছা, খারিজ, গায়েব, দোয়াত, নগদ, বাকি, মহকুমা, মুন্সেফ, মোক্তার, রায়  ইত্যাদি।
ফারসি শব্দ আইন, আমদানি, ঈদগাহ, কানুন, খানকাহ, গুনাহ, চশমা, জায়নামাজ, রোজা, দরগাহ, নামাজ, পরহেজগার, ফরিয়াদী, ফরমান, মাহিনা, রসদ, রসিদ, রাস্তা, সালিশ, সবজি, সবুজ, সরকার, সরাসরি, সর্দি, সাজা, সাদা, সুদ, সুপারিশ, সেতারা, শিরোনাম, শাদি, শাবাশ, হাজার, হাঙ্গামা, খোদা, গুনাহ, দোজখ, ফেরেশতা, বেহেশত, কারখানা, জবানবন্দি, তারিখ, তোশক, দফতর, দরবার, দোকান, দস্তখত, দৌলত, নালিশ, বাদশাহ, বান্দা, বেগম, মেথর, রসদ, আদমি, আমদানি, জানোয়ার, জিন্দা, নমুনা, বদমাশ, রফতানি, হাঙ্গামা ইত্যাদি।
ইংরেজি শব্দ অফিস, আফিম, ইউনিভার্সিটি, ইউনিয়ন, এজেন্ট, কলাম, গ্লাস, জ্যাম, ডায়েরি, লাগেজ, রেডিও, টেলিভিশন, স্কুল, হ্যান্ডবল, ফুটবল, চেয়ার, টেবিল, পেন, পেন্সিল, কলেজ, টিন, নভেল, নোট, পাউডার, ব্যাগ, ফুটবল, মাস্টার, লাইব্রেরি, স্কুল, ব্যাংক ইত্যাদি।
পুর্তগিজ শব্দ আনারস, আলপিন, আলকাতরা, আচার, আলমারি, কফি, কাকাতুয়া, কেরানি, গরাদ, পাউরুটি, পেয়ালে, বালতি, বেহালা, বর্গা, সাবান, সাবু, গির্জা, গুদাম, চাবি, পাদ্রি ইত্যাদি।
ফরাসি শব্দ কার্তুজ, কুপন, ক্যাফে, ডিপো, দিনেমার, রেস্তোরাঁ, রেনেসাঁ ইত্যাদি।
ওলন্দাজ শব্দ ইস্কাপন, টেককা, তুরুপ, রুইতন, হরতন ইত্যাদি।
হিন্দি শব্দ কাহিনি, খানাপিনা, চানাচুর, টইল, দাদা, নানা, পুরি, পানি, বার্তা, বাচ্চা, মিঠাই, সাচ্চা, কমসেকম, চলতি, দেবদাস ইত্যাদি।
গুজরাটি শব্দ খদ্দর, জয়ন্তি, হরতাল ইত্যাদি।
সিংহলি শব্দ বেরিবেরি, সিডর ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দ উজবুক, কাঁচি, কুর্নিশ, কুলি, তালাশ, তুর্ক, তোপ, দারোগা, বাবা, মোগল, লাশ, সাওগাত, চাকর, চাকু, তঙ্গা ইত্যাদি।
জাপানি শব্দ জুডো, প্যাগোডা, রিকশা, হারিকিরি, হাসনাহেনা,  সুনামি, ইমোজি ইত্যাদি।
পাঞ্জাবি শব্দ চাহিদা, শিখ, চড্ডি ইত্যাদি।
ইতালীয় শব্দ মাফিয়া, ম্যাজেন্টা, সনেট ইত্যাদি।
চীনা শব্দ এলাচি, চা, চিনি, লিচু, লবি, সাম্পান ইত্যাদি।
গ্রিক শব্দ কেন্দ্র, দাম, সুরঙ্গ ইত্যাদি।
মায়ানমার/বর্মি শব্দ ফুঙ্গি, লুঙ্গি।
মিশ্র রাজা-বাদশা (তৎসম+ফার্সি),
হাটবাজার (বাংলা+ফার্সি),
হেড-মৌলভি (ইংরেজি+ফার্সি),
হেড-পণ্ডিত (ইংরেজি+তৎসম),
খ্রিস্টাব্দ (ইংরেজি+তৎসম),
ডাক্তারখানা (ইংরেজি+ফারসি),
পকেটমার (ইংরেজি+বাংলা),
শাকসবজি (তৎসম+ ফারসি)।

মনে রাখার সহজ উপায়
ফারসি শব্দ দিপু (ডিপো ), কার্তুজ ও রেনেসাঁ তিন বন্ধু কুপন জিতে ক্যাফে–রেস্তোরাঁয় ডিনার (দিনেমার ) করতে গিয়ে রীতিমত ফরাসি (ইরানি) বনে গেল।
ফার্সি শব্দ
সেতারা বেগম গুনাহ  থেকে বাঁচার জন্য ও পরহেজগার  হওয়ার জন্য খানকাহ, দরগাহ কোনটাই বাদ রাখেন নি। তিনি সাদা জামা পড়ে চশমা–খানা  চোখে দিয়ে জায়নামাজে বসে নামায–রোজা  পালন করলেও ফ্রান্স সরকার  তাকে সুদ খেয়ে আইন–কানুন  অমান্য করার কারণে সাজা দেন। রাস্তার পাশে, সবুজ মাঠে, বাজারের কাছে সালিশ–নালিশ  হওয়ার পর বাদশাহ কোন রকম সুপারিশ না শুনে তাকে সরাসরি হাজতে পাঠায়। সেখানে তিনি সর্দি রোগে আক্রান্ত হয়ে পেরেশান হয়ে পড়েন। খবরে তার নামে শিরোনাম হলে দেশে হাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ে। কোন ফরমান না পেয়ে তিনি তারিখ গুণতে লাগলেন। অনেকে তাকে হাজার সাবাস  দিলেও তার ফরিয়াদ অনেকে শুনছেন না। অবশেষে তিনি ঈদগাহে গিয়ে এক মৌলভি বান্দাকে শাদি  করলেন। এবং আমদানিকৃত সবজি  ও রসদ (রশিদ) খেয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিলেন।
ওলন্দাজ শব্দ
ওলন্দাজ থেকে ইসকাপনের টেক্কা  পুলা তার বান্ধবী তুরুপের জন্য হরতন ও রুইতন নিয়ে আসল।
হিন্দি শব্দ ভারতীয় দাদা–নানাদের কাহিনি  শুনে বাচ্চারা খানাপিনা ও পানি ছেড়ে দিয়ে মিঠাই ও চানাচুর ধরেছে। এসব বার্তা পেয়ে সিলেটী পুরিরা সাচ্চা টহল  দিতে শুরু করেছে।
ইতালীয় শব্দ ইতালীয় মাফিয়ারা সনেট ও ম্যাজেন্টাকে এক জিনিস মনে করে।
তুর্কি শব্দ তুর্কি দারুগা তার বাবা সওগতকে বাবুর্চি  মনে করে তালাশ করলেন। কারণ তিনি হাতে কাঁচি ও গায়ে তোপ পড়ে কুলি করছিলেন। এদিকে তার দুই ভাই উজবুক ও মোগল লাশ  হয়ে ফিরে এলেন।
পাঞ্জাবি শব্দ
এখন পাঞ্জাবির চাহিদা শিখদের মধ্যে বেড়ে গেছে।
চায়না শব্দ
লবি (একটি মেয়ে) তার চায়না মোবাইলে সাম্পান -ওয়ালা গান শুনতে শুনতে চা, চিনি, লিচু ও এলাচি  সব খেয়ে সাবাড় করেছে।
জাপানি শব্দ
হাসনাহেনা রিকশায় করে প্যাগোড়ায় গেলেন। আসার সময় এক জুডো জাপানি হারাকিরি নিয়ে আসলেন।
গ্রিক শব্দ
বাজরাঙ্গি ভাইজান সুরঙ্গ দিয়ে না গেলেও তাকে কেন্দ্র করে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার দাম দিতে সাল্লু গ্রিক চলে গিয়েছিলেন।
পর্তুগিজ শব্দ
ইংরেজ গরাদ  বাবু কফি, পাউরুটি, আনারস ও আচার  খেতে খুবই পছন্দ করেন। তিনি সাবান, আলকাতরা ও আলপিন  ব্যবহার করেন না। তিনি একদিন সাবুকে চাবি  দিয়ে বললেন; বারান্দার আলমারি  থেকে বেহালাটি বের করে কেরানিকে দেওয়ার জন্য। এদিকে কেরানি বর্গা বালতিতে পেয়ারা ও পেয়ালে  রেখে কাকাতুয়া নিয়ে পর্তুগিজ চলে গেলেন।
ধন্যবাদান্তে: সাইফুল বিন আ. কালাম
(মনে রাখার সহজ কৌশল প্রণেতা)

বাংলা/বঙ্গের উপনিবেশ, বাংলার শাসকগন সম্পর্কে বিস্তারিত, পরিভাষা, বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে যোগাযোগ করুণ আমাদের ইমেইলে-
→ ইমেইল – admin@biratbazar.com

 

নতুন নতুন আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ইউটিউব এবং সোশ্যাল চ্যানেলে-
→ ইউটিউব – https://www.youtube.com/@BiratBazar
→ ফেইসবুক – https://www.facebook.com/BiratBazarOfficial
→ টুইটার – https://twitter.com/BiratBazar
→ ইন্সটাগ্রাম – https://www.instagram.com/biratbazar/
→ থ্রেডস – https://www.threads.net/@biratbazar
→ লিংকড ইন – https://www.linkedin.com/company/biratbazar

 

বাংলা বিশ্লেষণ সম্পর্কিত অন্যান্য পোস্টসমূহ-

২। ভাষারীতিতে বাংলা


বাংলাদেশ বিষয়াবলী সম্পর্কিত কিছু পোস্ট-

অংকের জাদু সম্পর্কিত কিছু পোস্ট-

Leave a Reply