fbpx
হযরত শাহজালাল রহ.

হযরত শাহজালাল রহ.


শাহ জালাল (রহ.) বাংলার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ। শুধু বাংলার নয়, সম্পূর্ণ পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি বিখ্যাত। পুরো নাম শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররদ। বলা হয়ে থাকে ২৫ মে ১২৭১ খ্রি. শাহ জালাল জন্মগ্রহণ করেন। বিভিন্ন ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক নথিতে তার জন্মস্থান নিয়ে বিতর্ক দেখা যায় এবং তার জীবন ও লিখিত জীবনির মধ্যে দুই শতাব্দীর ব্যবধান পাওয়া যায়। স্থানীয় গাথা অনুসারীরা তাকে “শাহ জালাল ইয়ামেনি” বলে উল্লেখ করত। কেননা ধারণা করা হয় তিনি ইয়েমেন থেকে এসেছেন। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে সালার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে প্রাপ্ত একটি শিলা লিপিতে জালালের নামের শেষে কুনয়াই শব্দটি পাওয়া যায়। একই শতাব্দীর শেষের দিকে ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে শেখ আলী শের বাঙ্গালীর ফার্সী কিতাব শরহে নুজহতুল আরওয়াহ এর ভূমিকায় শাহ জালালের জীবনী নিয়ে লেখা হয়। কিতাবের লেখক আলী শের বাঙ্গালী নিজেই ছিলেন শাহ জালালের উর্ধ্বতন শিষ্য নুরুল হুদা আবুল কারামতের বংশধর। ১৬১৩ সালে তাঁর শিক্ষক মুহম্মদ গৌছ শত্তারীর লিখিত গুলজর-ই-আবরার কিতাবে তাঁর এই বর্ণনা ব্যবহার হয়েছিল। এই বর্ণনায়, শাহ জালালকে একজন তুর্কিস্তান জন্মা বাঙ্গালী বলে ডাকা হয় এবং শাহ জালালকে তুর্কিস্তানের আহমদ ইয়াসাভীর মুরিদ বলা হয়। কুমিল্লার মুহম্মদ নাসিরউদ্দীন হায়দার যখন সিলেটে চাকুরীরত ছিলেন, তখন তিনি ফার্সি ভাষায় সুলেন-ই-ইয়ামন তারীখ-ই-জালালী নামক পূর্নাঙ্গ একটি জীবনী রচনা করেছিলেন। ১৮৫৯ সালের এই রচনার কারণেই শাহ-জালালকে ইয়েমেনী বলা হয়েছে। বিতর্কের কারণ এই গ্রন্থটি শাহ জালালের মৃত্যুর ৫ শতাব্দী পর লেখা হয়েছে। কিন্তু লেখক নাসিরউদ্দীন হায়দার (বর্তমানে অপ্রাপ্য) মহিউদ্দীন খাদেমের রিসাল (১৭১১) এবং রৌজাতুস সলাতীন (১৭২১) নামক দুইটি গ্রন্থসূত্র ব্যবহার করেছিলেন। ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাপ্ত হোসেন শাহী শিলালিপির কুনয়াই শব্দটি নিয়ে অনেক অভিমত রয়েছে। কিছু গবেষক মনে করেন এই শব্দটি তুরস্কের কূনিয়া শহরকে নির্দেশ করে এবং ধারণা করেন যে শাহ জালাল সম্ভবত পরবর্তীতে ইয়েমেন হেফাজত করেছিলেন। আবার কোনো কোনো গবেষক ধারণা করেন যে এই শব্দ ইয়েমেনের হাজরামাউত অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কনিনাহ গ্রামকে নির্দেশ করে। আবার কিছু পন্ডিতরা মত দিয়েছেন এটি সম্ভবত পূর্ব আফ্রিকার কেনিয়া দেশকে নির্দেশ করছে।

 

শাহ জালালের প্রাথমিক জীবন: সুলেহি ইয়্যামনিতে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে, ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রি.) সালে মোহাম্মদ বা মাহমুদের ঘরে শাহ জালাল জন্মগ্রহণ করেন। হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরাইশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর থেকে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। এদের মধ্যেই একজন ছিলেন শাহ জালালের পিতা মোহাম্মদ বা মাহমুদ। শাহ জালালের দাদার নাম ইব্রাহিম। সেই দিক থেকে দেখলে শাহ জালালের জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়েমেন দেশের কুনিয়া শহর।

জন্মগত ভাবেই শাহ জালাল দরবেশ পরিবারে জন্মেছিলেন। জানা যায়, তাঁর মাতা সৈয়দ বংশের প্রখ্যাত দরবেশ সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর দৌহিত্র ছিলেন। পিতা মোহাম্মদ ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী মোজাহিদ। শাহ জালাল মাত্র ৩ মাস বয়সে তাঁর মাকে হারিয়ে বাবা মাহমুদের কাছে বড় হতে থাকেন। কিন্তু শাহ জালালের যখন ৫ বছর বয়স তখন তাঁর বাবা ইয়েমেনের ধর্মযুদ্ধে গিয়ে নিহত হন। পরে মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির শাহ জালালকে ইয়েমেন থেকে মক্কায় তাঁর আস্তানায় (হোজরা) নিয়ে যান। আহমদ কবির মূলত আরবী ভাষায় কোরআন হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোযা ইত্যাদি) শিক্ষা দিতেন। শাহ জালাল তাঁর মামা আহমদ কবিরের আস্তানায় তাঁর মামার অন্যান্য শিষ্যদের সাথে শিক্ষা গ্রহণ করেন। মূলত শাহ জালালকে সুফি মতবাদে দীক্ষিত করাই মামা আহমদ কবিরের মূল উদ্যেশ্য ছিলো বলে জানা যায়। তাই তিনি শিশু জালালকে নিয়ে মক্কায় আসেন এবং ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয়ধারায় দীক্ষিত করেন।

আহমদ কবিরের আসল নাম শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি। তিনি সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারীর পুত্র এবং মুরশীদ ছিলেন। সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী শাহ জালালের জন্মের আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে মোলতানের নিকট আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এখান থেকেই শাহ জালালের পাক-ভারত উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের স্বপ্নের শুরু হিসেবে জানা যায়।

 

শাহ জালাল ছিলেন হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দীক্ষায় দীক্ষিত: হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর একনিষ্ট সাহাবী ও মুসলিম উম্মার খলিফা ছিলেন হযরত আলী (র.)। তাঁর থেকে আধ্যাত্মিক সাধনার জ্ঞান পান শেখ হাসান। শেখ হাসান বসরী তাঁর অর্জিত জ্ঞান বিতরন করলে তার শিষ্য শেখ হাবিব আজমী তা গ্রহণ করেন। শেখ হাবিব আজমী থেকে শেখ দাউদ তাঈ সেই আধ্যাত্মিক সাধনার জ্ঞান লাভ করে। শেখ দাউদ তাঈ এর শিষ্য শেখ মারুফ কারখী নিজে অর্পিত জ্ঞান চর্চা করে তা শেখ ছিররিউ সাকতীকে দান করে। পরে একে একে শেখ ছিররিউ থেকে শেখ মমশাদ দিনওয়ারী, শেখ মমশাদ দিনওয়ারী থেকে শেখ আহমদ আসওয়াদ দিন্নুরী এবং এভাবে পর্যায়ক্রমিকভাবে শেখ আমুরিয়া, শেখ আজিউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী, তাঁর ছেলে শেখ আবু নাজিব সোহরাওয়ার্দি, তাঁর ছেলে শেখ শিহাব উদ্দীন এই জ্ঞান সাধনা করে সোহরাওয়ার্দী তরিকায় একটি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বানায়। সেখানে থেকে শেখ বাহাউদ্দীন জাকারিয়া আধ্যাত্মিক সাধনার জ্ঞান লাভ করে তাঁর পুত্র সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী কে তা শিখান এবং সৈয়দ জালাল সুরুখ থেকে তাঁর পুত্র শাইখ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি শিখেন ও তা তত্ত্ববধান করেন। মক্কা শহরে সোহরাওয়ার্দি তরিকার প্রবর্তক ছিলেন শিহাব উদ্দীন সোহরাওয়ার্দি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত খানকা (মরমী স্কুল) এ তৎকালীন প্রধান তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন শাইখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি। তিনি শাহ জালাল কে মক্কায় নিয়ে আসলে শাহ জালাল তাঁর থেকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান, ইসলামের শরীয়ত ও মারিফত উভয় ধারায় দীক্ষিত হন।

 

শাহ জালালের ভারতবর্ষ নিয়ে স্বপ্ন: শাহজালাল ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখেন। পরে তা সৈয়দ আহমদ কবির-এর কাছে ব্যক্ত করেন। মামা শাহ জালালের স্বপ্নের বিষয়ে মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে তা জানান। কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে শাহজালালকে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে কবির শাহ জালালের হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেন: “যে স্থানে এই মাটির স্বাদ গন্ধ ও বর্ণের মিল এক হবে, সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে”। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রহ) এর দোয়া নিয়ে শাহ জালাল (রহ) ধর্মপ্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে যাত্রা শুরু করেন। শাহ জালাল মক্কা হতে বিদায় কালে যে কয়েক জন সঙ্গী নিয়ে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন সঙ্গী চাশনী পীর ছিলেন মৃত্তিকার তহবিলদার। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরকন্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজাম উদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আরিফ, গুজরাত থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ তার মুরীদ হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাঁর শিষ্য সংখ্যা ২৪০ জন হয় বলে ধারণা পাওয়া যায়। দিল্লিতে আসার পর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে শাহ জালালের কুৎসা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিজামুদ্দীন অন্যের কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তিস্বরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে শাহ জালালের কাছে সালাম পাঠান। শাহ জালাল সালামের উত্তরে উপটৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহ্ জালালের আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে তাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া তাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালি কবুতর নামে খ্যাত।

 

সিলেট বিজয়: শ্রীহট্টে ইসলাম জ্যোতি সহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে তুর্কি বিজয়ের মধ্য দিয়ে শ্রীহট্টে মুসলমান জনবসতি গড়ে ওঠে ছিল। সিলেটের টুলটিকর মহল্লায় ও হবিগঞ্জের তরফে তৎকালীন মুসলমানরা বসতি গড়েছিলেন। এ সময় শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে গৌড়-গোবিন্দ নামে এক রাজা ছিল। গৌড় রাজ্যের অধিবাসী বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক মুসলমান (হিন্দুরাজ্যে বসবাসকালে) নিজ ছেলের আকিকা উপলক্ষে গরু জবাই করে গৌড়ের হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দের কাছে অপরাধী সাব্যস্ত হন। এ কারণে, গোবিন্দ বুরহান উদ্দীনের শিশু ছেলেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে এরূপ মত প্রচলিত আছে। বুরহান উদ্দীন বাংলার তৎকালীন রাজা শামস উদ্দীন ফিরুজ শাহের নিকট গিয়ে এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ করলে রাজা তার ভাগিনেয় সিকান্দর গাজীকে প্রকাণ্ড সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যে প্রেরণ করেন। শাহী সৈন্য যখন ব্রহ্মপুত্র নদী পার হতে চেষ্টা করে তখনই রাজা গোবিন্দের সেনারা বীরত্বের সাথে মুসলিম সৈন্যের উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে সমস্ত চেষ্টাকে বিফল করে ফেলে। গোবিন্দের শক্তির প্রভাবে সিকান্দর গাজীর প্রতিহত ও বিফল মনোরথের সংবাদ দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজির নিকট পৌঁছলে সম্রাট এ সংবাদে মর্মাহত হন। পরবর্তিতে সম্রাট তার রাজদরবারী আলেম-উলামা সহ জ্যোতিষিদের সাথে আলোচনায় এই মর্মে অবহিত হন যে, গৌড়গোবিন্দ জাদুশক্তির সাহায্যে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। জ্যোতিষিদের মতে সুলতানের সেনাবাহিনীতে আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন এক ব্যক্তি রয়েছে, তার নেতৃত্বে অভিযান প্রেরণ করা হলে গৌড়গোবিন্দের যাদু বিদ্যার মোকাবেলা করে সিলেট বা শ্রীহট্ট জয় সম্ভব হবে। জ্যোতিষিরা উক্ত আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির পরিচয়ের পন্থা হিসেবে এও বলে ছিল, আগামী দুই/এক রাত্রের মধ্যে দিল্লী নগরীতে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টিতে সমস্ত নগরী ভেসে যাবে, প্রতিটি ঘর বাড়ির বিষম ক্ষতি লক্ষিত হবে, কোথাও কোন প্রদীপ থাকবে না; একটি মাত্র তাবু ব্যতীত। সম্রাট জ্যোতিষিদের কথামত অনুসন্ধান করে সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে দেখতে পেলেন একজন সাধারণ সৈনিক একটি তাঁবুতে একাগ্র মনে বসে কোরান পড়ছেন। সম্রাট সেখানে উপস্থিত হয়ে তার সব বিষয় অবগত হয়ে সিলেট অভিযানের নেতৃত্ব দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি সৈয়দ নাসির উদ্দীন, সম্রাটের আদেশে সম্মত হলে সম্রাট তাকে সিপাহসালার সনদের সাথে সিকান্দর গাজীর কাছে প্রেরণ করেন। এদিকে গাজী বুরহান উদ্দীন তখন দিল্লীতে অবস্থান করছিলেন। এসময় শাহ জালালও তার সঙ্গীদের নিয়ে দিল্লীতে আসেন। ঐতিহাসিক আজহার উদ্দীন ধারণা করে দিল্লীতেই বুরহান উদ্দীনের সাথে শাহ জালালের সাক্ষাৎ হয় এবং এখানেই বুরহান উদ্দীন নিজের দুঃখময় কাহিনী তার নিকট বর্ণনা করেন। শাহ জালাল দিল্লী হতে বুরহান উদ্দীনকে সহ ২৪০ জন সঙ্গীসহচর সিলেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা হলেন। শাহ জালাল সাতগাঁও এসে ত্রিবেণীর নিকট দিল্লীর সম্রাট প্রেরিত অগ্রবাহিনী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের সাথে মিলিত হন। সৈয়দ নাসির উদ্দীন শাহ জালাল সম্পর্কে অবগত হয়ে তদীয় শিষ্যত্ব গ্রহণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পথে পথে শাহ জালালের শিষ্য বর্ধিত হতে লাগল। ত্রিবেণী থেকে বিহার প্রদেশে আসার পর আরো কয়েকজন ধর্মযোদ্ধা অনুষঙ্গী হলেন। যাদের মধ্যে হিসাম উদ্দীন, আবু মোজাফর উল্লেখযোগ্য। এখান থেকে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনের আনিত এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্যসহ শাহ জালাল নিজ সঙ্গীদের নিয়ে সোনারগাঁ অভিমুখে সিকান্দর গাজীর সাথে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। শাহ জালাল সোনারগাঁ আসা মাত্রই শাহ সিকান্দর গাজীর সাথে সাক্ষাৎ ঘটিল। সিকান্দর গাজী শাহ জালালকে সসম্মানে গ্রহণ করলেন। শাহ জালাল তার সঙ্গী অনুচর ও সৈন্যসহ শাহ সিকান্দরের শিবিরে সমাগত হয়ে সিকান্দর হতে যুদ্ধ বিষয়ে সব বিষয় অবগত হন। সিকান্দর শাহ জালালের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিষ্যগ্রহণপূর্বক সিলেট অভিমুখে যাত্রা করলেন। এভাবে শাহ জালালের শিষ্য সংখ্যা বেড়ে ৩৬০ জনে পৌঁছায়। এদিকে গৌড় গৌবিন্দ নিজস্ব চর দ্বারা শাহ জালালের সমাগম সংবাদ পেয়ে; নতুন এ দল যাতে ব্রহ্মপুত্র নদী পার না হতে পারেন, সে জন্য নদীর সমস্ত নৌ-চলাচল বন্ধ করে দেয়। শাহ জালালের ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি তার শিষ্যদের নিয়ে বিনা বাধায় জায়নামাজের সাহায্যে ব্রহ্মপুত্র নদী অতিক্রম করেন। খ্রিস্টিয় দশম শতকে শ্রীহট্টভূমি লাউড়, জয়ন্তীয়া ও গৌড় নামে তিনটি স্বাধীন রাজ্যে বিভক্ত ছিলো। উক্ত রাজ্য গুলোর মধ্যে গৌড় অন্যতম রাজ্য হিসেবে বিবেচিত ছিল। এ রাজ্যে প্রাচীন সীমা রেখা বর্তমান মৌলভীবাজার জেলা সহ হবিগঞ্জ জেলার কিয়দংশ নিয়ে বিস্তৃত থাকায় গৌড় রাজ্যের দক্ষিণ সীমাভূমি নবীগঞ্জের দিনারপুর পরগণার পাশে রাজা গোবিন্দের চৌকি ছিল। শাহ জালাল তার সঙ্গীদের নিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদী পার হয়ে প্রথমত সেখানে অবস্থান করেন। এখানে গৌড়ের সীমান্ত রক্ষীরা অগ্নিবাণ প্রয়োগ করে তাদেরকে প্রতিহত করতে চায়; কিন্তু মুসলমান সৈন্যের কোন ক্ষতি করতে পারেনি। গোবিন্দ সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে উপায়ান্তর না পেয়ে বরাক নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। শাহ জালাল পূর্বের মতো জায়নামাজের সাহায্যে বরাক নদী পার হন। বরাক নদী পারাপারে বাহাদুরপুর হয়ে বর্তমান সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলায় ফতেহপুর নামক স্থানে রাত্রিযাপন করেন।

উল্লিখিত তথ্য-সংবলিত প্রাচীন গ্রন্থ তোয়ারিখে জালালীতে উল্লেখ আছে:

চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা দিনারপুর
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর
সেখানে আসিয়া তিনি পৌছিলা যখন
খবর পাইলা রাজা গৌবিন্দ তখন।
এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে
আসিয়া পৌছিলা এক নদীর পারেতে
বরাক নামে নদী ছিল যে মসুর
যাহার নিকট গ্রাম নাম বাহাদুরপুর।
যখন পৌছিলা তিনি নদীর কেনার
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।

সর্ব প্রকার কলাকৌশল অবলম্বন করে রাজা গৌড়গোবিন্দ যখন দেখলেন সকল প্রয়াসই বিফলে হচ্ছে, তখন শেষ চেষ্টা করার লক্ষে যাদুমন্ত্রসহ এক প্রকাণ্ড লৌহধনুক শাহ জালালের কাছে প্রেরণ করে; যার শর্ত ছিল যদি কেহ একা উক্ত ধনুকের জ্যা ছিন্ন করতে পারে তখন গোবিন্দ রাজ্য ছেড়ে চলে যাবে। শাহ জালাল তার দলের লোকদের ডেকে বললেন, যে ব্যক্তির সমস্ত জীবনে কখনও ফজরের নামাজ কাযা হয়নি বা বাদ পড়েনি একমাত্র সেই পারবে গোবিন্দের লৌহ ধনুক “জ্যা” করতে। অতঃপর মুসলিম সৈন্যদলের ভেতর অনুসন্ধান করে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীনকে উপযুক্ত পাওয়া গেলো এবং তিনিই ধনুক জ্যা করলেন। উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করার সময় সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়ে যায়। সিলেট বিভাগের বেষ্টনী হিসেবে ধর্তব্য এ নদীগুলো প্রাচীন কালে প্রবল স্রোতে প্রবাহিত হত। বর্ষাকালের দৃশ্য প্রায় সাগরের মত দেখাতো। ঐতিহাসিক পর্যটক ইবন বতুতা সুরমা নদীকে নহরি আজরফ বলে আখ্যায়িত করেছেন। শাহ জালাল ফতেপুর হতে যাত্রা করে যখন সুরমা তীরে অবস্থান নিলেন, এ নদী পার হয়েই গৌড়ের রাজধানী। শাহ জালাল আউলিয়ার কেরামতি ও অলৌকিক বিভিন্ন ঘটনায় রাজা গোবিন্দ বীতশ্রদ্ধ হন। গোবিন্দ শক্রবাহিনীকে কিছু সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য সুরমা নদীতে নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করেন। তা সত্ত্বেও শাহ্‌ জালাল বিসমিল্লাহ বলে সকল মুরিদকে নিয়ে জায়নামাজে করে, অনায়াসে গেলেন চলে নদীর ওপারে। গোবিন্দ গড়দুয়ারস্থিত রাজবাড়ি পরিত্যাগ করে পেচাগড়ের গুপ্তগিরি দুর্গে আশ্রয় নেন। ধারণা করা হয় পেচাগড়ের গুপ্তগিরির গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে গৌড় গোবিন্দ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শাহ জালাল তিন দিন সিলেটে অবস্থান করার পর, মিনারের টিলায় অবস্থিত রাজবাড়ি প্রথমে দখল নেন। তারপর রাজবাড়ির মিনারে সর্বপ্রথম রুদ্দিন আজান দেন। জানা যায় গোর গোবিন্দ পালিয়ে গেলে সিলেট জয়ের পর সিলেটের আশেপাশের এলাকা বিজয়ীদের দখলে আসে। শাহ জালাল (রঃ) তাঁর শিষ্যদের মধ্যে বিজিত অঞ্চল ভাগ করে দেন। তিনি তাঁদের বিয়ে করতে অনুমতি দান করেন, তবে তিনি নিজে কুমার থাকেন। এই উৎসে সিলেট বিজয়ের কৃতিত্ব শাহ জালাল (রঃ) ও তাঁর শিষ্যদের দেওয়া হয়েছে। তিনি তার নিকটতম সহচর হাজী মুহাম্মদ ইউসুফকে তার দরগার খাদিম (অভিভাবক) নিযুক্ত করেন এবং ইউসুফের বংশধর, সারেকাউম পরিবার এই ভূমিকা অব্যাহত রেখেছেন। এতে শাসনকারী রাজা বা তাঁর সেনাপতিদের কোন উল্লেখ নেই। 

মুসলমানদের প্রথম সিলেট বিজয় এবং সেখানে ইসলামের আবির্ভাব সম্পর্কিত প্রথম এবং গ্রহণযোগ্য তথ্যের উৎস হচ্ছে একটি ফারসি শিলালিপি। এটির তারিখ হচ্ছে ৯১৮ হিজরি/১৫১২ খ্রিস্টাব্দ এবং এটি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৪-১৫১৯ খ্রি) উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এ শিলালিপি অনুসারে শামসুদ্দীন ফিরুজ শাহের রাজত্বকালে সিকান্দর শাহ গাজী ৭০৩ হিজরি/১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম সিলেট জয় করেন। শিলালিপিটি শায়খ জালাল মুজাররদ ইবন মুহম্মদের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। এ শিলালিপিটি ঘটনার দুশ বছরের সামান্য পরে উৎকীর্ণ করা হলেও এটি ঘটনার নির্ভুল তারিখ প্রদান করে। হজরত শাহ জালাল (রঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের সিলেট বিজয়ের বিবরণ গওছীর গুলজার-ই-আবরার  গ্রন্থে পাওয়া যায় যা ১৬১৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয়। শায়খ আলী শের কর্তৃক লিখিত একটি পূর্বতন গ্রন্থ শরহ্-ই-নুজহাত-উল-আরওয়া থেকে নেওয়া উপাদানের সাহায্যে এটি লেখা হয়েছিল। শায়খ আলী শের ছিলেন শায়খ নূরুল হুদা আবুল কারামতের বংশধর।

 

ইবনে বতুতার মতে শাহ জালাল: সৌভাগ্যক্রমে ইবনে বতুতার ভ্রমণ-রোজনামচায় হজরত শাহ জালাল সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি শায়খকে একজন অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন অতিবৃদ্ধ মহান দরবেশ রূপে বর্ণনা করেছেন। তাঁকে বলা হয়েছিল যে, দরবেশ বাগদাদে খলিফা আল-মুস্তাসিম বিল্লাহকে দেখেছিলেন এবং খলিফার হত্যার সময় তিনি সেখানে ছিলেন। পরবর্তীকালে দরবেশের অনুচরবৃন্দ ইবনে বতুতাকে বলেছিলেন যে, দরবেশ ১৫০ বছর পরিণত বয়সে ইন্তেকাল করেছিলেন। তিনি প্রায় সারা বছরই রোজা রাখতেন। তিনি সারারাত নামায পড়তেন। তিনি ছিলেন শীর্ণ, লম্বা এবং তাঁর সামান্য দাড়ি ছিল। বহুপাহাড়ি এলাকার বাসিন্দাগণ তাঁর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তবে বিতর্কের বিষয় আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, ইবনে বতুতা বাংলায় এসেছিলেন ১৩৪৫-১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে। সুতরাং শায়খের মৃত্যু তারিখ ১৩৪৭ খ্রিস্টাব্দে নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু তিনি ছিলেন সায়্যিদ আহমদ য়াসাভির শিষ্য এবং সুফীদের নকশবন্দিয়া তরিকার লোক। তাই তিনি শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। আধুনিক কিছু পন্ডিত মনে করেন যে, দুজন জালালই (শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি এবং সিলেটের শাহ জালাল) এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু আধুনিক গবেষণা থেকে দেখা যায় যে তাঁরা ছিলেন দুজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। দুজনই ছিলেন বড় দরবেশ, বাংলার মানুষের উপর দুজনই বিশাল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তবে তাঁদের কর্মক্ষেত্র ছিল ভিন্ন। শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজির নাম মালদহের (পশ্চিমবঙ্গ) পান্ডুয়া ও দেওতলার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু শাহ জালালের নাম সিলেটের (পূর্ববঙ্গ) সঙ্গে জড়িত। তাঁদের সময়কালও ভিন্ন। শেখ জালালুদ্দীন তাবরিজি সিলেটের শাহ জালালের চেয়ে কমপক্ষে এক শতক আগে সক্রিয়ভাবে বর্তমান ছিলেন। প্রথমোক্ত ব্যক্তি ছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ (মৃত্যু ১২৩৬ খ্রি.), দিল্লির শেখ কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকি (মৃত্যু ১২৩৫ খ্রি.) এবং মুলতানের শায়খ বাহাউদ্দীন জাকারিয়ার (মৃত্যু ১২৬২ খ্রি.) সমসাময়িক। দরবেশদের জীবনীমূলক সাহিত্য অনুসারে জালালুদ্দীন তাবরিজি ১২২৬ অথবা ১২৪৪  খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেছিলেন। কাজেই শেষোক্ত তারিখটি মেনে নিলেও তিনি শাহজালালের মৃত্যুর ১০৩ বছর আগে ইন্তেকাল করেছিলেন। দুইজনই যে আলাদা, এটাই তাঁর প্রমাণ। তবে, এখনও বহু মানুষ শাহ জালাল (রঃ)-এর মাজার জিয়ারত করেন। তাঁর কবরটি অস্বাভাবিকরকম বড় (বাংলার মানুষের আকৃতির তুলনায়) এবং এটা ইবনে বতুতার সাক্ষ্যকে সমর্থন করে।


হযরত শাহজালাল রহ. সম্পর্কিত আরো জানতে যোগাযোগ করুণ আমাদের ইমেইলে-
ইমেইলadmin@biratbazar.com

 

নতুন নতুন আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ইউটিউব এবং সোশ্যাল চ্যানেলে-
ইউটিউব – https://www.youtube.com/@BiratBazar
ফেইসবুক – https://www.facebook.com/BiratBazarOfficial
→ টুইটার – https://twitter.com/BiratBazar
→ ইন্সটাগ্রাম – https://www.instagram.com/biratbazar/
থ্রেডস – https://www.threads.net/@biratbazar
লিংকড ইন – https://www.linkedin.com/company/biratbazar
 

হযরত শাহজালাল রহ. এর দরগাহ


Leave a Reply