বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি

কোনো একটি দেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান অথবা ভূ-প্রকৃতি জানতে হলে অবশ্যই আগে সেই দেশটির ভৌগলিক অবস্থান জানা অতিব প্রয়োজনীয়।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায়, ভারত ও মিয়ানমারের মাঝখানে। এর ভূখণ্ড ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার (বিবিএস ২০২০ অনুসারে) অথবা ১,৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার (সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক ২০২১ অনুসারে) এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশের পশ্চিম, উত্তর, আর পূর্ব জুড়ে রয়েছে ভারত। পশ্চিমে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।

বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা (২৩°৫`) অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা সমুদ্র সমতল হতে মাত্র ১০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। সমুদ্র সমতল মাত্র ১ মিটার বৃদ্ধি পেলেই এদেশের ১০% এলাকা নিমজ্জিত হবে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের উচ্চতম স্থান দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে পার্বত্য চট্টগ্রাম এর মোডকমুয়াল পর্বত, যার উচ্চতা ১,০৫২ মিটার (৩,৪৫১ ফুট)। বঙ্গোপসাগর উপকূলে অনেকটা অংশ জুড়ে সুন্দরবন অবস্থিত, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এখানে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিন সহ নানা ধরনের প্রাণীর বাস। ১৯৯৭ সালে এই এলাকাকে বিলুপ্তির সম্মুখীন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। বাংলাদেশের জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা এবং অসুবিধা উভয়ই রয়েছে। এর সুবিধাগুলি হলো:

  • এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্র
  • এটি একটি বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ
  • এটি একটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় দেশ

এর অসুবিধাগুলি হলো:

  • এটি একটি ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা
  • এটি একটি বন্যাপ্রবণ এলাকা
  • এটি একটি নদীপথ নির্ভর দেশ

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।


এবার জানা যাক ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে-

ভূ-প্রকৃতি বলতে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সমষ্টিকে বোঝায়। এটি পৃথিবীর ভূমিরূপ, জলবায়ু, মৃত্তিকা, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের সমন্বয়ে গঠিত। ভূ-প্রকৃতি পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ভূ-প্রকৃতির প্রধান উপাদানগুলি হলো:

  • ভূমিরূপ: ভূমিরূপ হলো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের বৈচিত্র্যময় আকৃতি। এটি ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানুষের কার্যকলাপের দ্বারা গঠিত হয়। ভূমিরূপের প্রধান প্রকারভেদগুলি হলো পাহাড়, সমভূমি, মালভূমি, উপত্যকা, সমুদ্র সৈকত ইত্যাদি।
  • জলবায়ু: জলবায়ু হলো একটি নির্দিষ্ট স্থানের দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ার গড় অবস্থা। এটি আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, বাতাসের গতি ও দিক, আর্দ্রতা ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়। জলবায়ু পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।
  • মৃত্তিকা: মৃত্তিকা হলো ভূপৃষ্ঠের উপরের স্তর, যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর অবশেষ, শিলাচূর্ণ ও অন্যান্য উপাদান দ্বারা গঠিত। মৃত্তিকা উদ্ভিদের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
  • উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত: উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলি ভূ-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বিবর্তিত হয়েছে।

ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্র্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে। এটি মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে।


এবার আসি বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতি সম্পর্কে-

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি মূলত তিনটি প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত:

  • টারশিয়ারি যুগের পাহাড় সমূহ – এই অঞ্চলটি উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে অবস্থিত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গারো, খাসিয়া, জৈন্তিয়া ও খাগড়াছড়ি পাহাড় এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে চট্টগ্রাম পাহাড় অবস্থিত। এই পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ১২০১ মিটার এর বেশি নয়।
  • প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ – এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। উত্তরাঞ্চলে বরেন্দ্রভূমি, মধ্যাঞ্চলে মধুপুর ও ভাওয়ালের গড় এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে লালমাই পাহাড় অবস্থিত। এই অঞ্চলের মাটির রং লাল বা ধুসর।
  • সাম্প্রতিক কালের প্লাবন সমভূমি – এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এই অঞ্চলটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, যমুনা, পদ্মা প্রভৃতি নদ-নদীর পলিমাটি দ্বারা গঠিত। এই অঞ্চলটি অত্যন্ত উর্বর এবং বাংলাদেশের প্রধান জনবসতি এলাকা।

অঞ্চলগুলির বিশ্লেষণ

টারশিয়ারি যুগের পাহাড় সমূহ

বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১২% এলাকা নিয়ে টারশিয়ারির যুগের পাহাড়সমূহ গঠিত। তার টারশিয়ারি যুগে হিমালয় পাহাড় উত্থিত হওয়ার সময় এ সকল পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই অঞ্চল বাংলাদেশের তিনটি ভূ-প্রাকৃতিক অঞ্চল সমূহের মধ্যে প্রাচীনতম। পাহাড় সমূহ ভাজ বা ভঙ্গিল পর্বতের শ্রেণীর। পাহাড়গুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে

 

 

ক) দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চল: রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবস্থিত। পাহাড় গুলো আসামের লুসাই এবং মিয়ানমারের আরাকান পাহাড়ের সমগোত্রীয়।এই পাহাড়গুলো বেলে পাথর, সেলে পাথর এবং কর্দম দ্বারা গঠিত। এ অঞ্চলে পাহাড়গুলোর গড় উচ্চতা ৬১০ মিটার (২০০০ফুট)।বিখ্যাত সাজেক উপত্যকা রাঙ্গামাটি জেলায় অবস্থিত। সাজেক ভেলিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়।

 

 

খ) উত্তর উত্তর-পূর্বাঞ্চল : সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা অঞ্চলে অবস্থিত। পাহাড়গুলোর উচ্চতা ২৪৪ মিটার বেশি নয়। স্থানীয়ভাবে টিলা নামে পরিচিত।

প্লাইস্টোসিনকালের সোপানসমূহ

বাংলাদেশের মোট ভূমির ৮%এলাকা নিয়ে এ ভূমি গঠিত। প্লাইস্টোসিনকালে (আনুমানিক ২৫০০০বছর পূর্বে) এসব সোপানগুলো গঠিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। সোপন গুলো হল-

 

ক) বরেন্দ্রভূমি: রাজশাহীর উত্তরাংশ, বগুড়ার পশ্চিমাংশ, রংপুর ও দিনাজপুরের কিছু অংশ নিয়ে পড়ন্ত ভূমি গঠিত। প্রায় ৯৩২০ বর্গ কিলোমিটার।

 

খ) মধুপুর ও ভাওয়ালের গড়: টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় মধুপুর এবং গাজীপুর জেলায় ভাওয়ালের গড় অবস্থিত।

 

গ) লালমাই পাহাড়: কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত পাহাড়টির গড় উচ্চতা 21 মিটার।

সাম্প্রতিকালের প্লাবন সমভূমি

সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ৮০%  ভূমি নদীবিধৌত এক বিস্তীর্ণ সমভূমি। এ প্লাবন সমভূমির আয়তন প্রায় ১ লক্ষ ২৪ হাজার ২৬৬ বর্গ কিলোমিটার।এ সমভূমি  বাংলাদেশের উত্তর অংশ থেকে উপকূলের দিকে ক্রমনিম্ন।  সুন্দরবন অঞ্চল প্রায় সুমুদ্র  সমতল অবস্থিত। সমুদ্র সমতল থেকে বাকি অঞ্চলগুলো যেমন- দিনাজপুরের উচ্চতা ৩৭.৫০ মিটার,বগুড়া  উচ্চতা ২০ মিটার, ময়মনসিংহের উচ্চতা ১৮ মিটার, নারায়ণগঞ্জ ও যশোর উচ্চতা ৮ মিটার।

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি এর বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:

  • এটি একটি ব-দ্বীপ
  • এর ভূমিরূপ অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়
  • এটি একটি উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চল
  • এটি একটি বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ

বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি এর বৈচিত্র্য এটিকে একটি অনন্য দেশ হিসাবে গড়ে তুলেছে। এটি দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে।

বাংলাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ

  • তাজিংডং বা বিজয়: বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় উচ্চতা ১২৩১ মিটার (৪৫০০ফুট)
  • কেওক্রাডং: বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় উচ্চতা ১২৩০ মিটার (৪৩৩০০ফুট)
  • মোদকটং বা সাকা হাফাং: বান্দরবান জেলার, থানচি উপজেলায় ১০০০ মিটার

 

বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পাহাড়

  • গারো পাহাড় – ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত, বাংলাদেশের সবচেয়ে উচু পাহাড়।
  • চন্দ্রনাথ পাহাড় – সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
  • চিম্বুক পাহাড় ও নীলগিরি পাহাড় – বান্দরবান৷ চিম্বুক পাহাড়কে পাহাড়ের রানী বলা হয়।
  • আলিটুলা গোহা ও পাহাড় – খাগড়াছড়ি।
  • কালাপাহাড় – মৌলভীবাজার।
  • জৈয়ন্তিকা পাহাড় – সিলেট।

Leave a Comment

Recent Posts

মালনীছড়া চা বাগান

উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠিত ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া বাংলাদেশের সিলেট সদর উপজেলার ৩নং খাদিম নগর ইউনিয়নের এয়ারপোর্ট রোডে… Read More

1 week ago

Malnicherra Tea Garden

The Malnicherra Tea Garden, the oldest and largest established tea plantation in the Indian subcontinent, is located on the outskirts… Read More

1 week ago

হযরত শাহজালাল রহ.

শাহ জালাল (রাহ.) বাংলার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ। শুধু বাংলার নয়, সম্পূর্ণ পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি বিখ্যাত। পুরো নাম শাহ জালাল… Read More

1 month ago

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবান জেলার প্রবেশ পথে (বান্দরবান-কেরাণীহাট) সড়কের পাশে পার্বত্য জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এটি বান্দরবান শহর থেকে… Read More

2 months ago

Meghla Tourism Complex

Meghla Tourism Complex is located at the entrance of Bandarban district, along the Bandarban-Keranihat road, adjacent to the Hill District… Read More

2 months ago

বাকলাই জলপ্রপাত

বাকলাই জলপ্রপাত বাংলাদেশের বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার নাইটিং মৌজার বাকলাই গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়দের নিকট “বাক্তলাই ঝর্ণা” নামেও পরিচিত। মুলত কেওক্রাডং… Read More

3 months ago