ভাষারীতিতে বাংলা

ভাষারীতিতে বাংলা


পৃথিবীর সকল দেশেরই রয়েছে নিজস্ব ভাষা এবং রয়েছে তাদের নিজস্ব ভাষারীতি। অঞ্চলভেদে রয়েছে ভাষার বিভিন্নতা। বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের ভাষায় কথা বলে। কোনো অঞ্চলের ভাষার সাথে কোনো অঞ্চলের ভাষা পুরোপুরি মিল থাকেনা, তবে আংশিক মিল থাকতে পারে। কিন্তু অঞ্চলভেদে এই ভাষার ভিন্নতাই ভাষাকে বিভিন্নতা এনে দেয়। এই বিভিন্নতাই আঞ্চলিক কথ্য ভাষা বা উপভাষা। পৃথিবীর সব ভাষারই রয়েছে ছোট বড় উপভাষা। এক অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষা অন্য অঞ্চলের জনগণের মুখের ভাষার সাথে যথেষ্ট পার্থক্য থাকায় ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের লোকের মুখের ভাষা বোঝা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে দূরত্ব ভেদে ভাষার দুর্বোধ্যতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই এ ধরণের আঞ্চলিক ভাষাকে বলার ও লেখার ভাষা হিসেবে সর্বক্ষেত্রে স্বীকৃতি দেয়া যায় না। কারণ তাতে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাভাষীদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদানে জটিলতা দেখা যায়। সেজন্যই একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট এবং আদর্শ ভাষা থাকে। যে ভাষায় দেশের শিক্ষিত ও পন্ডিত সমাজ পারস্পারিক আলাপ আলোচনা ও ভাবের আদান প্রদান করে থাকেন। বিশ্বের প্রতিটি ভাষারই রয়েছে দুটি প্রধান রূপ। একটি কথ্য রূপ অপরটি লেখ্য রূপ।

বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সর্বজনস্বীকৃত আদর্শরূপ চলিত রীতি। বাংলা ভাষার কথ্য রূপের রয়েছে দুটি রীতি। একটি চলিতরীতি অপরটি আঞ্চলিক রীতি। ঠিক তেমনই লেখ্য রূপেরও রয়েছে দুটি রীতি। একটি সাধু রীতি অপরটি চলিত রীতি। তবে সাধুরীতি সর্বজনস্বীকৃত লেখ্যরূপ এবং চলিতরীতি সর্বজনস্বীকৃত কথ্য রূপ। তবে কালের বিবর্তনে চলিতরীতিও এখন সর্বজনস্বীকৃত আদর্শ কথ্য ও লেখ্য রূপ হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে চলিতরীতির এ প্রভাব এর প্রধান কারণ, ভাষা পরিবর্তনশীল। প্রতিটি মুহুর্তে ভাষা একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিটি ভাষাভাষী লোকজন তাদের ভাষার কঠিন শব্দটিকে পাল্টে সহজ করে নিচ্ছে, ছোট করে নিচ্ছে, আবার প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে নতুন নতুন শব্দ গ্রহণ করছে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে নানা কৌশল প্রয়োগ করে নতুন নতুন শব্দও তৈরি করছে। এমনকি পুরোনো কোনো শব্দ নতুন অর্থে ব্যবহার করেও শব্দটির নতুন অর্থদ্যোতকতা তৈরি করে নতুন শব্দ তৈরি করা হচ্ছে। চলিতরীতির ভাষা জনমনে কঠিনত্বের প্রকাশ ফেলেনা।

আঞ্চলিক ভাষারীতি: বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের নিজেদের মধ্যে যে ভাষায় কথা বলে, তাকেই আঞ্চলিক কথ্য রীতি বা আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা বলে। সকল ভাষাতেই আঞ্চলিক ভাষা থাকে। এবং বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মুখের ভাষায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়। এগুলো কোনোভাবেই বিকৃত ভাষা নয়, এগুলো শুদ্ধ ও প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক ভাষারীতি।

সাধুরীতি: পূর্বে সাহিত্য রচনা ও লেখালেখির জন্য তৎসম শব্দবহুল, দীর্ঘ সর্বনাম ও ক্রিয়াপদ সম্পন্ন যে গুরুগম্ভীর ভাষারীতি ব্যবহৃত হতো, তাকেই সাধু ভাষা বলে। এই ভাষা অত্যন্ত গুরুগম্ভীর, দুরূহ এবং এতে দীর্ঘ পদ ব্যবহৃত হয় বলে এই ভাষা কথা বলার জন্য খুব একটা সুবিধাজনক না। তাই এই ভাষায় কথাও বলা হয় না। এই ভাষা কেবল লেখ্য রীতিতে ব্যবহারযোগ্য। তাও বহু আগেই লেখ্য রীতি হিসেবে চলিত রীতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় সাধু রীতি এখন লেখ্য ভাষা হিসেবেও ব্যবহৃত হয় না। কেবল সরকারি দলিল-দস্তাবেজ লেখা ও অন্যান্য কিছু দাপ্তরিক কাজে এখনো এই রীতি ব্যবহৃত হয়।

চলিতরীতি: দেশের সকল মানুষ যে আদর্শ ভাষারীতিতে কথা বলে, যেই ভাষারীতি সকলে বোঝে, এবং যে ভাষায় সকলে শিল্প-সাহিত্য রচনা ও শিক্ষা ও অন্যান্য কাজকর্ম সম্পাদন করে, সেটিই চলিত ভাষারীতি। এই ভাষায় যেমন সাহিত্য সাধনা বা লেখালেখি করা যায়, তেমনি কথা বলার জন্যও এই ভাষা ব্যবহার করা হয়। সকলে বোঝে বলে বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে, যেমন কোনো অনুষ্ঠানে বা অপরিচিত জায়গায় বা আনুষ্ঠানিক (formal) আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে এই ভাষারীতি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ, এই রীতি লেখ্য ও কথ্য উভয় রীতিতেই ব্যবহৃত হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকেই চলিত ভাষা বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নিতে থাকে। সংস্কৃত নির্ভর সাধুভাষা ক্রমশ পণ্ডিতি ভাষায় পরিণত হয়। ফলে সাধুভাষা নিষ্প্রাণ ও স্থবির হয়ে যেতে থাকে। লেখকদের মধ্যে অচিরেই এ বোধ জাগ্রত হতে থাকে যে গদ্যকে প্রাণবাণ ও জীবন্ত রাখতে হলে কথ্যভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। প্যারীচাঁদ মিত্রের “আলালের ঘরের দুলাল” ও কালীপ্রসন্ন সিংহের “হুতোম প্যাঁচার নকশা” প্রথম কথ্যভাষায় রচিত দুটি গদ্যগ্রন্থ। পরবর্তীকালে প্রমথ চৌধুরী তাঁর “সবুজপত্র” পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের ভাষা হিসাবে চলিত ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রনাথও চলিত ভাষায় লিখে একে অসামান্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। রবীন্দ্রপরবর্তী যুগ থেকে বাংলা গদ্যে চলিতরীতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে সাহিত্যের প্রায় সবটুকুই চলিতরীতির আদর্শে রচিত হচ্ছে। তাছাড়া সংবাদপত্রের ভাষা থেকে আরম্ভ করে ব্যবহারিক সর্বক্ষেত্রেই চলিতভাষাই আমাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। 

সাধু ও চলিত রীতির উদ্ভব ও বিকাশ

বাংলা সাহিত্যের আদি ও মধ্য যুগে ভাবপ্রকাশের একমাত্র বাহন ছিল কবিতা। চিঠিপত্র ও দলিল-দস্তাবেজে বাংলা গদ্যের একটি অস্পষ্ট রূপ এ সময় পাওয়া গেলেও এগুলো ছিলো একেবারেই প্রাথমিক ও অবিকশিত। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে ইংরেজ শাসন চালু হওয়ার পর বাংলা গদ্যের যাত্রা শুরু হয়। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০) প্রতিষ্ঠার পর ইংরেজ সিভিলিয়ানদের জন্য বাংলা গদ্যগ্রন্থের অভাব অনুভূত হয়। এর ফলেই এখানে বাংলা গদ্য চর্চার একটি সমন্বিত প্রয়াস শুরু হয়। উনিশ শতকে বাংলা সাময়িক পত্রের প্রকাশ বাংলা গদ্য রচনার সুযোগ সম্প্রসারিত করে।

এছাড়া রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র প্রমুখ চিন্তাবিদ ও সমাজ সংস্কারক এ সময়ই সমাজ সংস্কারের জন্য গদ্য চর্চা শুরু করেন। তাঁরা এ সময় অন্যান্য লেখকদের প্রচেষ্টায় সকল অঞ্চলের শিক্ষিত বাঙালির জন্য একটি সাধারণ ও গ্রহণযোগ্য লিখিত ভাষা গড়ে তোলেন। এ ভাষার মূল নির্ভরতা ছিল সংস্কৃত ভাষার উপর। শব্দচয়ন, বাক্যগঠন কৌশল সব কিছুতেই সংস্কৃতের প্রভাব ছিল গভীর। উনিশ শতকে গড়ে উঠা এ ভাষার নাম সাধুভাষা। সাধুভাষা একদিনে তার রূপ-লাবণ্য, শ্রী ও সৌন্দর্য লাভ করেনি। বহুজনের মিলিত প্রয়াসে সাধুভাষা সাহিত্যের ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রথমযুগে রামমোহন, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, ঈশ্বরচন্দ্র এবং পরবর্তী যুগে বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মশাররফ হোসেন, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ গদ্যলেখকের হাতে সাধুভাষা প্রতিষ্ঠা, প্রচার ও প্রসার লাভ করে। উনিশ শতকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা গদ্যচর্চা শুরু হয়। এ সময় সাময়িকপত্রের প্রকাশ ও সমাজ সংস্কারকদের বাংলা গদ্য চর্চার ফলে বাংলা সাধু গদ্য বিকশিত হতে থাকে। বহুজনের মিলিত প্রয়াসে বাংলা সাধুগদ্য পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত। 


সাধু ও চলিতরীতির বৈশিষ্ট্য
সাধুরীতির বৈশিষ্ট্য
চলিতরীতির বৈশিষ্ট্য
১। সাধুরীতির ক্রিয়াপদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়াপদে তা লক্ষণীয়। যেমন:-
সমাপিকা ক্রিয়া: করিয়াছি, খাইয়াছি, পড়িয়াছি, লইয়াছি, গাহিয়াছি ইত্যাদি।
অসমাপিকা ক্রিয়া: করিয়া, খেলিয়া, পড়িয়া, ধরিয়া, গাহিয়া ইত্যাদি।

২। সাধুরীতিতে সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন: তাহারা, আমাদিগকে, উহাদের, ইহাদের, তাহাদের ইত্যাদি।

৩। সাধুরীতিতে অনুসর্গ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন: হইতে, থাকিয়া, দিয়া, রহিয়া, চাহিয়া ইত্যাদি।

৪। সাধুরীতিতে তৎসম অব্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন: তথাপি, যদ্যপি ইত্যাদি।

৫। সাধুরীতিতে তৎসম শব্দ বেশি ব্যবহৃত হয় বলে তা গুরু-গম্ভীর।

৬। সাধুরীতি কৃত্রিম এবং তা প্রাচীন বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।

৭। সাধু ভাষায় সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদ বেশি থাকে।

৮। সাধুরীতি নাটকের সংলাপ ও বক্তৃতার অনুপযোগী।


নিচের উদাহরণে সাধুরীতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাবে:
১। সাধারণের জিনিসকে বিশেষভাবে নিজের করিয়া, সেই উপায়েই তাহাকে, পুনশ্চ বিশেষভাবে সাধারণের করিয়া তোলা সাহিত্যের কাজ।
২। তোমার আত্মা হইতে যেমন তুমি বিচ্ছিন্ন হইতে পার না, সাহিত্যকেও তুমি তেমনি অস্বীকার করিতে পার না—উহাতে তোমার মৃত্যু—তোমার দুঃখ ও অসম্মান হয়।
৩। মেয়ে কথাটি কহিল না, মাটির শূন্য কলসীটি তুলিয়া লইয়া সেই রৌদ্রের মাঝেই চোখ মুছিতে মুছিতে নিঃশব্দে বাহির হইয়া গেল।
১। চলিতরীতির ক্রিয়াপদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়। সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ায় তা প্রকাশ পায়। যেমন:-
সমাপিকা ক্রিয়া: করেছি, খেয়েছি, পড়েছি ইত্যাদি।
অসমাপিকা ক্রিয়া: করে, খেলে, পড়ে, ধরে, গেয়ে ইত্যাদি।

২। চলিতরীতিতে সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্তরূপে ব্যবহৃত হয়। যেমন:- তারা, এদের, ওদের, তাদের, ওর ইত্যাদি।

৩। চলিতরীতিতে অনুসর্গের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন:  হতে, থেকে, চেয়ে ইত্যাদি।

৪। চলিতরীতিতে তদ্ভব অব্যয় ব্যবহৃত হয়। যেমন: তবু, যদিও ইত্যাদি।

৫। চলিতরীতিতে তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দ বেশি পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। ফলে চলিতরীতি হালকা বা গতিশীল।

৬। চলিতরীতি মুখের ভাষা বলে বাস্তবানুসারী এবং আঞ্চলিক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

৭। চলিতরীতিতে ভাষা হালকা করার জন্য সন্ধি ও সমাসবদ্ধ পদ ভেঙে ব্যবহার করা হয়।

৮। চলিতরীতি পরিবর্তনশীল। একশ বছর আগে যে চলিতরীতি মুখের বুলি হিসেবে প্রচলিত ছিল, বর্তমানে তা পরিবর্তিত হয়েছে।


নিচের উদাহরণে চলিতরীতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যাবে:
১। আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠে দেখি যে, যে দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সমগ্র আকাশ বর্ষায় ভরে গিয়েছে। পুল পেরিয়ে সামনে বাঁশ বাগান পড়ল।
২। বৃক্ষের পানে তাকিয়ে আমরা লাভবান হতে পারি—জীবনের গূঢ় অর্থ সম্বন্ধে সচেতন হতে পারি বলে। মচমচ করে শুকনো বাঁশ পাতার রাশ ভেঙে যেতে লাগল।
৩। কেউ বলেছিল, আমরা আসলে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি। ওরা বহু অত্যাচার করেছে আমাদের ওপর। শোষণ করেছে। তাই ওদের তাড়াবার জন্য লড়ছি।

সাধু ও চলিতরীতির পার্থক্য
১। সাধুরীতির ক্রিয়াপদ প্রসারিত ও পূর্ণরূপে এবং চলিতরীতিতে তা সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়।
যেমন:
সাধুরীতিতে— যাইতেছি, পড়িয়াছি ইত্যাদি।
চলিতরীতিতে— যাচ্ছি, পড়েছি ইত্যাদি।
২। সর্বনাম সাধুরীতিতে প্রসারিত ও পূর্ণরূপে এবং চলিতরীতিতে সংক্ষিপ্তরূপে ব্যবহৃত হয়।
যেমন:-
সাধুরীতির সর্বনাম তাহারা, ইহাদের ইত্যাদি।
চলিতরীতিতে তারা এদের ইত্যাদি।
৩। সাধু ভাষার অনুসর্গ ‘হইতে’, ‘থাকিয়া’ ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত হয়ে চলিতরীতিতে ‘হতে’, ‘থেকে’ রূপে ব্যবহৃত হয়।
তেমনি, অপেক্ষা > চেয়ে, দ্বারা, দিয়া > দিয়ে, বলিয়া > বলে, ধরিয়া > ধরে।
৪। সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের প্রাধান্য আর চলিত ভাষার অ-তৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি) শব্দের প্রাধান্য দেখা যায়।
যেমন:-
অষ্টপ্রহরীয় (তৎসম) > আটপৌরে (তদ্ভব), গৃহিণী (তৎসম) > গিন্নি (অর্ধতৎসম), কুম্ভাকার (তৎসম) > কুমার (তদ্ভব) ইত্যাদি।
৫। সাধু ভাষায় সমাসবদ্ধ শব্দ ও সন্ধিজাত শব্দ ব্যবহৃত হয়ে ভাষাকে আড়ম্বরপূর্ণ ও গম্ভীর করে তোলে, অন্যদিকে চলিতরীতি সেসব সমাসবদ্ধ ও সন্ধিজাত শব্দ ভেঙে ব্যবহৃত হয়ে উচ্চারণকে হালকা করে।
যেমন:-
হস্তধারণ > হাতধরা, গাত্রোত্থান > ওঠা, কৃষ্ণবর্ণ > কাল রঙ ইত্যাদি।
৬। অব্যয় ব্যবহারে সাধুরীতিতে তৎসম অব্যয় এবং চলিতরীতিতে তদ্ভব অব্যয় ব্যবহৃত হয়।
যেমন:-
সাধুরীতিতে ‘তথাপি’, ‘যদ্যপি’ ইত্যাদি।
চলিতরীতিতে ‘তবু’, ‘যদি’ ইত্যাদি।
৭। শব্দের স্বরসঙ্গতি, অভিশ্রুতি ও সমীকরণে সাধু ও চলিতরীতির পার্থক্য আছে।
সাধুরীতিতে ‘বাহিরে’ এবং চলিতরীতিতে ‘বাইরে’ আবার সাধুরীতিতে ‘বাহির’ কিন্তু চলিতরীতিতে ‘বের’ অথবা ‘বার’ ইত্যাদি।
৮। শব্দগঠনের জন্য উপসর্গের প্রয়োগ সাধুরীতিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ, কিন্তু চলিতরীতিতে সীমিত।
৯। সাধুরীতিতে সংস্কৃত প্রত্যয়ের নিয়ম মেনে চলতে হয়, চলিতরীতিতে নিয়ম না মানার প্রবণতা থাকে।
১০। ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রাধান্য চলিত ভাষায় যত, সাধু ভাষায় তত নয়।
১১। সাধু ভাষায় বাক্যরীতি সুনির্দিষ্ট থাকে, কিন্তু চলিতরীতিতে সুনির্দিষ্ট থাকে না।
যেমন:-
সাধুরীতিতে ‘আমি কলেজে পড়িতে যাইতেছি’।
চলিতরীতিতে বৈচিত্রপূর্ণ হতে পারে:-
‘আমি কলেজে পড়তে যাচ্ছি’,
‘আমি কলেজে যাচ্ছি পড়তে’,
‘আমি পড়তে যাচ্ছি কলেজে’,
‘আমি যাচ্ছি পড়তে কলেজে’ ইত্যাদি।
১২। প্রবাদ প্রবচন, বাগধারা যথাযথরূপে চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয়। সাধু ভাষায় অনুরূপ বাগভঙ্গিমা থাকে না।
১৩। সাধুরীতি গঠনে কৃত্রিম, উচ্চারণে গুরুগম্ভীর, গতিতে ধীর; অপরদিকে চলিতরীতি গঠনে স্বাভাবিক, উচ্চারণে হালকা এবং গতিতে সাবলীল।
সাধু ও চলিতের গঠনে এসব পার্থক্য থাকায় লেখার সময় তা মেনে চলা দরকার। তবে লেখকের দক্ষতার ওপর তা নির্ভরশীল। বিশেষত গাম্ভীর্যের বিষয়ে এমনও দেখা গেছে যে সাধুরীতিতে হালকা শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে এবং চলিতরীতি হয়ে উঠেছে গাম্ভীর্যপূর্ণ—যথাযথ প্রকাশের জন্য কৃতি লেখকের হাতে তা সার্থকভাবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। তবে সাধু এবং চলিতের মিশ্রণকে গুরুচন্ডালী দোষ বলেও অনেকে অভিহিত করেন।

 


বাংলা ভাষারীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মন্তব্য, ভাষারীতি নমুনা, ভাষারীতির রুপান্তর অথবা ভাষারীতি সম্পর্কে আরো জানতে চাইলে যোগাযোগ করুণ আমাদের ইমেইলে-
ইমেইলadmin@biratbazar.com

 

নতুন নতুন আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ইউটিউব এবং সোশ্যাল চ্যানেলে-
ইউটিউব – https://www.youtube.com/@BiratBazar
ফেইসবুক – https://www.facebook.com/BiratBazarOfficial
টুইটার – https://twitter.com/BiratBazar
ইন্সটাগ্রাম – https://www.instagram.com/biratbazar/
থ্রেডস – https://www.threads.net/@biratbazar
লিংকড ইন – https://www.linkedin.com/company/biratbazar

 

বাংলা বিশ্লেষণ সম্পর্কিত অন্যান্য পোস্টসমূহ-
১। বাংলা ভাষার জন্ম

বাংলাদেশ বিষয়াবলী সম্পর্কিত কিছু পোস্ট-


অংকের জাদু সম্পর্কিত কিছু পোস্ট-

Leave a Comment

Recent Posts

চিংড়ি ঝর্ণা

বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় এই চিংড়ি ঝর্ণার অবস্থান। মূলত বগালেক থেকে কেওক্রাডং এর মধ্যবর্তী স্থানে প্রায় ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথ… Read More

3 days ago

Chingri Falls

Chingri Jharna, located in the Ruma Upazila of Bandarban district in Bangladesh, is situated roughly an hour's hike along the… Read More

3 days ago

বগালেক

বগালেক যা বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা থেকে ১৫ কি.মি দূরে কেওক্রাডং পাহাড়ের কোল ঘেসে অবস্থিত। আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছরেরও… Read More

3 weeks ago

Bogalek

Which is located at the foothills of Keokradong Hills, 15 km from Ruma Upazila of Bandarban District. More than 2,000… Read More

3 weeks ago

গ্রেফতার কাকে বলে এবং গ্রেফতারের পদ্ধতি কি

ফৌজদারী কার্যবিধি আইন ১৮৯৮ এর ৪৬ ধারা মোতাবেক কোন ব্যক্তি কথা বা কাজের দ্বারা হেফাজতে আত্মসমর্পণ না করলে পুলিশ অফিসার… Read More

3 weeks ago

আমিয়াখুম জলপ্রপাত

বাংলাদেশের 'নায়াগ্রা ফলস' খ্যাত আমিয়াখুম জলপ্রপাত। যা বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ঘেঁষা নাক্ষিয়ং নামক স্থানে অবস্থিত। বিভিন্ন অঞ্চলে… Read More

2 months ago