ইমাম নববী (রহ.)-এর জীবনী
প্রায় চৌদ্দশত ৫০ বছর পরে পবিত্র কুরআনুল কারিম সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত ও অবিকৃত অবস্থায় আমাদের সামনে রয়ে গেছে। হাদিস বিকৃত করার বহুতর অপচেষ্টা চালানো হয়েছে কিন্তু উম্মতে মুহাম্মাদী অসাধারণ পরিশ্রম, আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও ত্যাগের বিনিময়ে সত্য, নির্ভূল ও যথার্থ হাদিসগুলোকে বাছাই করে সংরক্ষিত রাখতে সক্ষম হয়েছে। রাসূল (সাঃ)- এর জীবনকাল থেকে হাদিস লেখার সোনালী অধ্যায়ের সূত্রপাত হয়। প্রথম দিকে সাহাবী, তাবেঈ ও তাবে-তাবেঈগণ বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক পৃথক পৃথক গ্রন্থাকারে হাদিস লিপিবদ্ধ করতে থাকেন। ইমাম নববী (রহ.) তন্মধ্যে অন্যতম।
✍️নাম ও বংশধারাঃ-
ইমাম নববীর মূল নাম “ইয়াহইয়া” ডাকনাম “জাকারিয়া” পুরো নাম “শাইখ মহিউদ্দিন আবু জাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবনে শারাফ আল-নাবাবী আল দামে” উপাধি “মহিউদ্দিন, ইমাম।”
✍️জন্ম পরিচয়ঃ-
ইমাম নববী (রহ.) ৫ই মুহররম, ৬৩১ মোতাবেক ১২৩৩ খ্রিস্টাব্দে দামেস্কের সন্নিকটে “নাওয়া” নামক স্থানে বর্তমান সিরিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন।
✍️শৈশবকাল ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ-
ইমাম নববী (রহ.) তার শৈশবকাল বর্তমান সিরিয়ার “নাওয়া” নামক জনপদে অতিবাহিত করেন। লেখাপড়ার হাতেখড়ি ও হয় এই এলাকায়। মক্তবে আরবি বর্ণমালা শিক্ষা, আল কুরআন তিলাওয়াত ও হিফজুল কুরআনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু করেন। শৈশব ও কৈশোরে খেলাধূলার প্রতি তার কোন মনোযোগই ছিলো না। পিতা ব্যবসায় সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। তিনি ভদ্র ও শান্তশিষ্ট ছিলেন। তিনি কৈশোরে করআন মুখস্থ করেন। তাঁর স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও জ্ঞান অর্জনের প্রতি গভীর অনুরাগ তার শিক্ষকদের আকৃষ্ট করেছিল।তিনি স্বল্প সময়ে কুরআন, হাদিস, নাহু, সরফ, মানতিক, ফিকহ এবং উসূল আল-ফিকহ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।
✍️উচ্চতর শিক্ষা লাভঃ-
ইমাম নববী (রহ.) প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর উচ্চতর জ্ঞানার্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। তখন পিতা উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাণকেন্দ্র দামেস্কে চলে আসেন। দামেস্কে উচ্চতর জ্ঞান আরোহণে তৎকালীন যগের শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ ও শ্রেষ্ঠ আলেমদের সান্নিধ্য লাভ করেন। বিশেষত প্রসিদ্ধ উস্তাদ কামাল ইবনে আহমাদের কাছে তিনি অধিক সময় অতিবাহিত করেন।
✍️বিভিন্ন বিষয়ে পাণ্ডিত্য অর্জনঃ-
তিনি প্রতিদিন ১২টা বিষয় পড়তেন। উল্লেখযোগ্য ছিল – আল জামউ বাইনাস সহিহাইন, সহিহ মুসলিম, নাহু, সরফ, মানতিক, উসূলে ফিকহ ও আসমাউর রেজাল। তিনি কোন বিষয় একবার পড়লে স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে থাকত।
✍️চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যঃ-
ইমাম নববী (রহ.) একজন আলেম ও মুহাদ্দিস হিসাবেই খ্যাত ছিলেন না, তার উন্নত চরিত্র, তাকওয়া ও অনাড়ম্বর জীবনযাপন ও সমকালীন ইসলামি সমাজে আদর্শ হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। তিনি মোটা কাপড় পরিধান করতেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, আমীর-ফকির সবাই তাকে সম্মান করতেন। দুনিয়ার এত সম্মান লাভ করার পর ও কখনো অর্থ, সম্মান, পদ, ও ক্ষমতার পিছনে ছুটেননি। তিনি কখনো সরকারি অর্থ ও সহায়তা গ্রহণ করেননি। এমনকি কারো কাছে কোন দান ও গ্রহণ করেননি।
✍️ইসলাম প্রচার ও সাধনায়ঃ-
ইমাম নববী (রহ.) ইসলামের একজন নিবেদিত কর্মী ছিলেন। তিনি ইলমের প্রচার ও প্রসারে জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেন। সারাদিন ইলমের প্রচার ও প্রসার করতেন না বরং ইবাদত বন্দেগীতে গভীরভাবে মনোনিবেশ করতেন। অল্পক্ষণ আরাম করতেন। সারা দিন-রাতের মধ্যে একবার খেতেন, আর যখনই খেতেন শুধু পানি খেতেন। ইলম চর্চায় দিন দিন তার ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যারা পরবর্তীতে অনেকেই জগৎজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন।
✍️ইমাম নববীর গ্রন্হরচনাঃ-
ইমাম নববী (রহ.) তার ৪৫ বছরের জীবনকালে অনেক মূল্যবান গ্রন্থ প্রনয়ণ করেছেন। উল্লেখযোগ্য হলো- শারহু সহিহ আল বুখারী, কিতাবুল রাওদাহ, শরহে মুহাযযাব, কিতাবুল আযকার, কিতাবুল মুবহামাত, আল ফাতওয়া, জামেউস সুন্নাহ, খুলাসাতুল আহকাম, বুস্তানুল আরেফীন, আল-আরবাঈন আন-নববিয়্যাহ, মানাকিবুল শাফিয়িয়্যাহ ও শারহু সুনানে আবু দাউদ।
✍️ইন্তিকালঃ-
হাদিস শাস্ত্রের অন্যতম দিপাল ইমাম নববী (রহ.) ৬৭৫ হিজরি মোতাবেক ১২৭৭ খ্রিস্টাব্দে ১০ই ডিসেম্বর সিরিয়ার রাজধানী দামস্কের নিকট “নাওয়া” গ্রামে ইন্তিকাল করেন।