ইমাম বুখারী (রহ.) এর জীবনীইমাম বুখারী (রহ.) এর জীবনী

ইমাম বুখারী (রহ.)- এর জীবনী


হিজরি তৃতীয় শতকে যে সকল মুহাদ্দিসগণের অক্লান্ত পরিশ্রমে হাদিস শাস্ত্র সর্বাপেক্ষা উন্নতি, অগ্রগতি, প্রসার লাভ করেছে তাদের মধ্যে ইমাম বুখারী (রহ.) ছিলেন অন্যতম।

✍️নাম ও বংশ পরিচয়ঃ-

ইমাম বুখারী (রহ.) এর নাম:- মুহাম্মদ ইবনে ইসমাঈল ইবনে ইব্রাহীম ইবনে মুগীরাহ ইবনে বারদিযবাহ আল বুখারী আল জুফী।

উপনাম:- আবু আব্দুল্লাহ                                                         উপাধি :- আমিরুল মুমিনীন ফিল হাদিস

পিতার নাম:- ইসমাঈল                                                            পিতামহের নাম:- ইব্রাহীম

 

✍️জন্মস্থানঃ-

আব্বাসীয় খলিফা আল আমীন এর শাসনামলে ১৯৪ হিজরি সাল মোতাবেক ১৩ই শাওয়াল শিক্ষা-সংস্কৃতির লীলাভূমি বুখারায় (বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত) জন্ম গ্রহণ করেন।  (সূত্র:- তারীখুল মাদীনাতুদিমাশক)

 

শৈশবকাল ও দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়াঃ-

তিনি শৈশবেই পিতৃহারা হন। মায়ের তত্ত্বাবধানে লালিত-পালিত হন।বুখারায় ইয়াতীম অবস্থায় তার শৈশবকাল অতিবাহিত হয়। শৈশবকালেই বসন্তরোগে তিনি চোখের জ্যোতি হারিয়ে ফেলেন।তার মা অতিশয় আল্লাহ ভীরু ছিলেন।রাতে তাহাজ্জুদের সালাতে ছেলের দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাওয়ার জন্য দোয়া করতেন। আল্লাহর ইচ্ছা আর মায়ের দোয়ায় তিনি পুনরায় চোখের জ্যোতি ফিরে পান।(সূত্র:- শারহুল বুখারী, ১ম খন্ড)

 

✍️বাল্যকাল ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ-

প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় নিজ মায়ের নিকটে। ৫ বছর বয়সে বুখারায় একটি শিক্ষালয়ে ভর্তি হন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি ৬ বছর বয়সে পবিত্র কুরআনুল কারিম মুখস্থ করেন।প্রাথমিক শিক্ষার্জনের সময় তার হাদিস শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহের সৃষ্টি হয়।১৬ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বেই তিনি বিভিন্ন শায়খের নিকট গমন করে তাদের নিকট হাদিস সংগ্রহ ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।

 

✍️উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ ভ্রমণঃ-

তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তিতে হাদিসের জ্ঞান অন্বেষণে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বহির্দেশে যাত্রা শুরু করেন। তিনি সিরিয়া ও মিশর ভ্রমণ করেন। জাযীরায় ২ বার মিশরে ৪ বার যাতায়াত করেন। হিজাজে ৬ বছর অবস্থান করেন। কুফা ও বাগদাদে অগণিত বার গমন করেন। তার বয়স ১৮ হওয়ার পূর্বেই লোকেরা তার থেকে জ্ঞান অর্জন শুরু করেন। সহিহ ও দূর্বল হাদিস সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান থাকা সত্বেও হাদিসের সনদ ও মতন কন্ঠস্থের বিষয়ে তিনি কখনো বিতর্কে লিপ্ত হতেন না।

 

✍️অসাধারণ স্মৃতিশক্তিঃ-

তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তি ও মেধার অধিকারী ছিলেন। কৈশোর বয়সে তিনি ৭০ হাজার হাদিস মুখস্থ করেছিলেন। তিনি যে গ্রন্থ একবার পড়েন তা মুখস্ত হয়ে যেত। তার অসাধারণ ও বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির খ্যাতি গোটা মুসলিম বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। তিনি নিজেই বলেছেন- “আমার ১ লক্ষ সহিহ হাদিস এবং ২ লক্ষ গায়রে সহিহ হাদিস মুখস্থ আছে।” (সূত্র:- তাবাকাতুল হানাবিলাহ, ১ম খন্ড)

বিভিন্ন শহরে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্নভাবে ইমাম বুখারীর এ স্মৃতিশক্তি পরীক্ষা করে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছেন এবং সকলেই স্বীকার করেছেেন যে, হাদিস শাস্ত্রে তার সমকক্ষ আর কেউ নাই। (সূত্র:- আল হাদিস আল মুহাদ্দিসুন)

 

✍️ইবাদত ও তাকওয়াঃ-

ইমাম বুখারী (রহ.) ছিলেন স্বল্পভোজী, শিষ্যভোজী, শিষ্যগণের প্রতি অধিক ইহসানকারী এবং অত্যন্ত পরহেজগার ব্যক্তি। তিনি দিবা-নিশিতে অধিক হারে কুরআন তিলাওয়াত করতেন।  প্রতি রাতে ১৩ রাকাত সালাত আদায় করতেন। তিনি দিনে-রাতে, প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে দান করতেন। তিনি অনেক সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তিনি ১৬ বছর বয়সে মা ও ভাইয়ের সাথে হজ্জ সমাপন করেন। তিনি কোন দিন কারো গীবত করেননি। (সূত্র:- তাহযীবুল আসমা, ১ম খন্ড)

 

✍️মহৎ চরিত্রের অধিকারীঃ-

তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার, মানবদরদী ও মহৎ চরিত্রের অধিকারী।  পিতার অগাধ সম্পদ ছিল। শৈশবে পিতা ইন্তেকাল করার কারণে তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বিরাট ধন-সম্পদ গরীব-দুঃখীদের মধ্যে ও হাদিস শিক্ষার্থীদের মাঝে বিলিয়ে দেন। তিনি নম্র স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি কখনো কারো প্রতি রাগান্বিত হতেন না।

 

✍️হাদিস সংগ্রহ ও দেশ ভ্রমণঃ-

ইমাম বুখারী (রহ.) হাদিস শিক্ষা ও সংগ্রহের উদ্দেশ্যো সর্বপ্রথম ২১০ হিজরি সালে দেশ ভ্রমণ শুরু করেন। তিনি অনেক দেশ ও শহর পরিভ্রমণ করেছেন। এভাবে বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের এমন কোন প্রদেশ ও উল্লেখযোগ্য এমন কোন শহর ছিল না যেখানে তিনি উপস্থিত হয়ে হাদিস সংগ্রহ করেননি।

ইমাম বুখারী (রহ.) সিরিয়া, মিশর, জাযীরাহ, বাগদাদ, কুফা, বসরা, আসালান, হিমছ প্রভৃতি শহর পরিভ্রমণ করে সেখানকার মুহাদ্দিসগণের নিকট হাদিস সংগ্রহ করেন।মক্কা ও মদীনায় মহানবী (সাঃ) এর সকল হাদিস পাওয়া যেতনা কারণ রাবীগণ তখন ইসলামি সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন।

 

✍️কর্ম জীবনঃ-

ইমাম বুখারী (রহ.) ১৭ বছর বয়সে শিক্ষা-দিক্ষা সমাপ্ত করেন। ১৮ বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পূর্বেই লোকেরা তার নিকট হতে জ্ঞান অর্জনের জন্য আগমন করে। তিনি ইলমে হাদিসে গভীর পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। তার এ জ্ঞানের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক ছাত্র তার দরবারে উপস্থিত হতে লাগল। তিনি যখন শিক্ষা দান শুরু করেন তখন তার মুখে দাঁড়িই উঠেনি।।

 

✍️মাজহাবঃ-

তিনি কোন মাজহাবের অনুসারী ছিলেন না।

 

✍️হাদিস সংকলনে ইমাম বুখারীর (রহ.)  অবদানঃ-

তিনি হাদিস শাস্ত্রে উজ্জ্বল নক্ষত্র সদৃশ। ১৮ বছর বয়স থেকে তিনি গ্রন্থ রচনা ও সংকলনে মনোনিবেশ করেন। তিনি অসাধ্য সাধনার মাধ্যমে এক অনবদ্য হাদিস গ্রন্থ মুসলিম জাতিকে উপহার দেন। হাদিস সংকলনে তার অবদান বিস্ময়কর। যেমন:-

(ক) সহিহুল বুখারী বা আল জামি সংকলনঃ- তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হচ্ছে সহীহুল বুখারী।  গ্রন্থটি সংকলন করতে ১৬ বছর সময় লেগেছিল। ইমাম বুখারী (রহ.) ৬ লক্ষ হাদিস থেকে যাচাই এবং নির্বাচনের মাধ্যমে  তার সহিহ গ্রন্থটি সংকলন করেন। পুনঃপুন উল্লেখিত হাদিসসহ বুখারীর হাদিস সংখ্যা ৭৩৯৭ টি। পুনঃপুন হাদিস ছাড়া মুত্তাসিল হাদিসের সংখ্যা ২৬০২ টি। এ গ্রন্থটিতে ২২ টি সুলাসিয়াত হাদিস রয়েছে।  ১৬০ টি অধ্যায় ও ৩৪৫০ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। কুরআনের পর আসমানের নিচে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ গ্রন্থ সহিহুল বুখারী।

(খ) অন্যান্য হাদিস সংকলনঃ- ইমাম বুখারী (রহ.) এর প্রণীত আরো বহু গ্রন্থ রয়েছে। যেমন:-

১. কাযায়াস সাহাবাতি ওয়াত-তাবিঈন

২. আত-তারীখুল কাবীর

৩. আত-তারীখুস-সাগীর

৪. আল আদাবুল মুফরাদাত

৫. রফউল ইয়াদাইন

৬. কিতাবুল কুনা

৭. আল মাসনাদুল কাবীর ও

৮. কিতাবুর রিকাক অন্যতম।

 

✍️গ্রন্থ রচনাঃ-

তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ নিম্নরূপ

১. খালকু আফাআলিল ইবাদ

২. আল আকীদা আত-তাওহীদ

৩. বিররুল ওয়ালিদাইন

৪. আত-তাফসীরুল কাবীর

৫. কিতাবুল হিবাহ

৬. কিতাবুল মাবসূত

৭. কিতাবুল ওয়াহদান ও

৮. আসামিস সাহাবাহ অন্যতম।

 

✍️শিক্ষকমন্ডলীঃ-

তিনি বিভিন্ন শহর পরিভ্রমণ করে যে সমস্ত মুহাদ্দিসগণের নিকট থেকে হাদিস শ্রবণ করেন তাদের সংখ্যা ১ হাজারের অধিক। কারো কারো মতে ইমাম বুখারীর (রহ.) শিক্ষক ছিলেন ১০৮০ জন। (সূত্র:- হুদা আস-সারী)

 

✍️ইন্তিকালঃ-

জগৎ বিখ্যাত ইমাম বুখারী (রহ.) ২৫৬ হিজরির ঈদুল ফিতর রাতে এশার সালাতের পর সমরকন্দ থেকে ২ ফারসাখ দূরে “খরতংক” নানক স্থানে ইন্তিকাল করেন। ঐ দিন জোহরের সালাতের পর তার দাফন করা হয়। তখন তার বয়স ছিল ১৩ দিন কম ৬২ বছর। (সূত্র:- তাহযীবুল আসমা, ১ম খন্ড)

 

Leave a Reply