উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) ছিলেন সমসাময়িক যুগের অন্যতম। ফকীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, আলিম ও বাগ্নী। বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সহধর্মিনী হিসেবে তিনি ছিলেন জ্ঞান গরিমা ও রূপ সৌন্দর্যে এক অনন্য মহিয়সী নারী । অল্প বয়সে রাসূল (সা.) এর বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রিয় রাসূলের অকৃত্রিম ভালবাসায় হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন পৃথিবীর অপরাপর নারীদের তুলনায় স্বার্থক ও মর্যাদাবান। আর তিনিই ছিলেন রাসূল (সা.) এর ঘরোয়া বিষয় ও নারী সম্পর্কিত হাদিস ও মাসআলা বর্ণনায় অধিক নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণীয় ব্যক্তিত্ব। অসংখ্য সাহাবি ও তাবেয়ী তাঁর নিকট থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন ।
→ হযরত আয়েশা (রা.) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী :
উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) এ বর্ণাঢ্য জীবনী-
১. নাম ও পরিচয় :
তাঁর নাম- আয়েশা, উপনাম-উম্মে আব্দুলাহ, উপাধি-সিদ্দিকা, হোমায়রা, খেতাব-উম্মুল মুমিনিন, পিতার নাম-আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। মাতার নাম- উম্মে রুমান (যয়নব)। উল্লেখ্য, তিনি নিঃসন্তান হওয়া সত্ত্বেও তার বোনের ছেলে আব্দুলাহ ইবনে যোবায়েরের পরিচয়ে তাকে উম্মে আব্দুলাহ বলা হয়।
২. জন্মকাল :
উম্মুল মুমিনিন হযরত আয়েশা (রা.) রাসূল (সা.) এর নবুওয়াত প্রাপ্তির ৫ম বছর তথা হিজরতের আট বছর পূর্বে ৬১৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন আশৈশব মুসলিম।
৩. বিবাহ বন্ধন :
হযরত খাদিজার ইন্তিকালের পর নবুওয়াতের দশম সনে শাওয়াল মাসে মাত্র ছয় বছর বয়সে মক্কায় রাসূল (সা.) এর সাথে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়। অতঃপর হিজরি প্রথম বছর শাওয়াল মাসে তিনি রাসূল (সা.) এর ঘরে যান এবং বাসর রাত কাটান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯ বছর। তিনিই ছিলেন রাসূল (সা.) এর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। রাসূল (সা.) তাঁকে খুবই ভালোবাসতেন।
৪. কৃতিত্ব :
ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন নজিরবিহীন। কুরআন হাদিসের জ্ঞানবিজ্ঞান ও শরিয়তের মাসয়ালা-মাসায়েলের ব্যাপারে তিনি ছিলেন মহিলাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় । প্রাচীন আরবের অবস্থা এবং প্রাচীন আরবি কাব্য সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ বুৎপত্তি ছিল।
৫. পবিত্রতা ঘোষণা :
ষষ্ঠ হিজরিতে সংঘটিত বনু মুস্তালিকের যুদ্ধে তাঁর প্রতি মুনাফিকরা ইফকের যে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিল তার প্রত্যুত্তরে আল্লাহ তা’আলা আল কুরআনের সূরা নূরের ১১, ২৪ ও ২৬ নং আয়াত দ্বারা মুনাফিকদের অপবাদ খন্ড করে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করেন।
→ হাদিসশাস্ত্রে তাঁর অবদান :
রাসূল (সা.) যখন ইন্তিকাল করেন তখন তাঁর বয়স আঠারো বছর। মহানবি (সা.) এর ইন্তিকালের পরও দীর্ঘ ৪৮ বছর যাবৎ তিনি হাদিসের শিক্ষা দান ও প্রচার কার্যে যে অবদান রেখে গেছেন তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে চিরকাল। বহু সংখ্যক সাহাবি এবং পরবর্তীকালে তাবেয়ী তাঁর থেকে হাদিস শ্রবণ করেছেন ।
১. বর্ণিত হাদিস:
সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারীদের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তিনি রাসূল (সা.) থেকে সর্বমোট ২২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে বুখারী ও মুসলিমে সম্মিলিতভাবে ১৭৪টি, আর এককভাবে বুখারীতে ৫৪টি এবং মুসলিমে ৫৮টি হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
২. মাসয়ালা প্রবর্তন :
হযরত আয়েশা (রা.)-কে কেন্দ্র করে শরিয়তে কয়েকটি মাসয়ালার প্রবর্তন হয়েছে। যেমন- তায়াম্মুমের বিধান, অপবাদের শাস্তির বিধান তথা ব্যভিচারের শাস্তির বিধান।
৩. ইলমের খেদমত :
হযরত আয়েশা (রা.) ইলমে হাদিস এবং ফিকহের যে খেদমত করেছেন তা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। হযরত আবু বকর (রা.), হযরত উমর (রা.), এবং হযরত উসমান (রা.) এর খিলাফতকালে তিনি ফাতওয়া দান করতেন । প্রখ্যাত সাহাবিগণের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ও তিনি যে সমস্ত সূক্ষ্ম আপত্তি উপস্থাপন করেছেন সেগুলো আল্লামা সুয়ুতী স্বীয় গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন।
৪. বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দানের মাধ্যম :
হাদিস শাস্ত্র অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী আয়েশা (রা.)-এর নিকট যেকোনো ব্যক্তি দ্বীনী ব্যাপারে যেকোনো ধরনের প্রশ্ন করার অনুমতি পেতেন। মদিনা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার মুসলমানগণ তাঁর নিকট অহরহ আসতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসের আলোকে তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর প্রদান করতেন। এর মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিস সম্পর্কে অবহিত করতেন। যেমন- আলকাম (রহ.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম যে, নবি (সা.)-এর আমল কেমন ছিল? তিনি কি আমলের জন্য কোনো দিন নির্দিষ্ট করেতেন? আয়েশা (রা.) উত্তরে বললেন না, বরং তিনি সদা সর্বদা একই রূপ আমল করতেন তোমাদের কে আছে যে, নবি (সা.)-এর ন্যায় আমল করতে সক্ষম হবে?
৫. বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে :
নবি জীবনের ছোট বড় বিভিন্ন ঘটনা পরবর্তীতে লোকদের মাঝে বর্ণনা করার মাধ্যমেও আয়েশা (রা.) তাদেরকে হাদিস শিক্ষা দান করতেন। যেমন-হিশাম ইবন উরওয়া আয়েশা (রা.) হতে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নবি (সা.)-এর নিকট একদা এক শিশু আনা হলো। শিশুটি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কোলে পেশাব করে দিলে তিনি ঐ কাপড়ের উপর পানি ছিটা দিয়ে ঝেড়ে ফেললেন, তা আর ধৌত করলেন না ।
৬. মদিনায় হাদিস শিক্ষা দান :
আয়েশা (রা.) ছিলেন নবি (সা.)-এর হাদিসের বিশিষ্ট সংরক্ষণকারিণী। রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে অসংখ্য হাদিস শিক্ষা লাভ করেই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি, বরং সেগুলো অপরকে শিক্ষা দান, প্রচার ও প্রসারেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। নবি (সা.)-এর নির্দেশ : “আমার থেকে একটি বাণী জানা থাকলেও তা অপরের নিকট পৌঁছে দাও।”
“উপস্থিত ব্যক্তির নিকট যেন (আমার বাণী) পৌঁছিয়ে দেয়।” এ সকল নির্দেশ হাদিস বর্ণনায় সাহাবিদেরকে অধিক অনুপ্রাণিত করেছিল। পুরুষ সাহাবিগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হাদিসের প্রচার ও প্রসার কল্পে দুর-দুরান্তে সফর করেছেন । যেহেতু মহিলা সাহাবিদের বিচরণ ছিল সংরক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত। তাই হাদিসে রাসূলের অন্যতম জ্ঞানী মহীয়সী নারী ব্যক্তিত্ব আয়েশা (রা.) মদিনায় অবস্থান করেই হাদিস বর্ণনা দান ও সম্প্রসারণে ব্রতী হন।
৭. হযরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস বর্ণনার মূলনীতি :
আয়েশা (রা.) প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন ছিলেন বিধায় রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অধিকাংশ হাদিসই তাঁর মুখস্ত ছিল। অনায়াসেই তিনি সেগুলো লোকদের নিকট বর্ণনা করতেন। অপরপক্ষে, যে সকল হাদিস তিনি প্রত্যক্ষভাবে শুনেননি, বরং অন্যের মাধ্যমে শুনেছেন, সেগুলো বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতেন। সূক্ষ্ণ বিচার- বিশেষণ ও যাচাই-বাছাই এরপর পূর্ণ আস্থা জন্মিলে তা বর্ণনা করতেন। পরস্পর বিরোধী হাদিসের ক্ষেত্রে তিনি মূল প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে এর সমাধান করতেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) ব্যতীত অন্যের নিকট থেকে শুনা হাদিস কেউ তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি যথাসম্ভব তাকে মূল বর্ণনাকারীর নিকট প্রেরণ করতেন। যাতে বর্ণনার ধারাটি বলিষ্ঠ থাকে ।
৮. আয়েশা (রা.)-এর বর্ণিত হাদিসের স্বরূপ ও প্রকৃতি :
আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসগুলোতে মানব জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান লাভ করেছে। বিষেশত নারী জীবনের অনেক খুটি-নাটি বিষয় মুসলিম নারী সমাজ তাঁর বর্ণিত হাদিসের মাধ্যমে অবহিত হয়েছে। এ ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যক্তিসত্তা, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চিকিৎসা, পবিত্রতা, শারঈ বিধিবিধান, ইবাদত, পরকাল প্রভৃতি বিষয়েও তিনি হাদিস বর্ণনা করে মুসলিম উম্মাহকে বিশেষভাবে উপকৃত করেছেন ।
৯. হযরত আয়েশা (রা.)-এর হাদিস সংকলন :
হযরত আয়েশা (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ থেকেই হাদিস সংকলন শুরু করেন । তিনি হযরত উরওয়া ইবনে যুবায়রকে সংকলনের দায়িত্ব প্রদান করেন । উরওয়া বিন যুবায়েরের নেতৃত্বে ওমরা বিনতে আব্দুর রহমান ও আবু বকর ইবনে মুহাম্মদ ইবনে আমর ইবনে হাযম প্রমুখ হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসসমূহ সংকলন করেন। সংকলনে সন্নিবেশিত হাদিসের সংখ্যা প্রায় ২২১০টি।
১০. ইন্তিকাল :
হযরত আয়েশা (রা.) ৬৬/৬৭ বছর বয়সে হিজরি ৫৭/৫৮ সনের ১৭ রমযান মঙ্গলবার দিবাগত রাতে মদিনায় ইন্তিকাল করেন । তখন ছিল আমিরে মুয়াবিয়ার শাসনকাল। তখন তার বয়স হয়েছিল ৬৬ বছর।
১১. জানাযা ও দাফন :
স্বীয় অসিয়ত মোতাবেক জান্নাতুল বাকীতে হযরত আয়েশা (রা.) কে সমাহিত করা হয়। তখন হযরত আবু হুরায়রা (রা.) মাওয়ান বিন হাকামের পক্ষে থেকে মদীনায় শাসনকর্তা নিযুক্ত ছিলেন । তিনিই তাঁর জানাযার ইমামতি করেন।
সর্বোপরি হযরত আয়েশা (রা.) ছিলেন অসাধারণ মেধার অধিকারিণী। তিনি মুজতাহিদ সাহাবিদের সমপর্যায়ের ছিলেন। তিনি তাফসীর, হাদিস, ফিকহ, সাহিত্য সব বিষয়েই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। বাগ্মীতায়ত্ত তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিলো। তিনি সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবিগণের মধ্যে অন্যতম। তাঁর থেকে অগণিত সাহাবি ও তাবেয়ী হাদিস বর্ণনা করেছেন। সর্বোপরি বহুবিধ গুণের অধিকারী উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) আল্লাহর রাসূলের অতি আদুরে সহধর্মিনী ছিলেন।
হযরত আয়েশা (রা.) ও হাদিসশাস্ত্র সম্পর্কে আরো জানতে যোগাযোগ করুণ আমাদের ইমেইলে-