মাটির গভীরে আস্ত এক শহর!
তুরস্কের আনাতোলিয়ার কাপাদোশিয়ায় অবস্থিত এক আজব শহর ডেরিংকুয়ো ভূগর্ভস্থ শহর। যা ১৯৬৩ সাথে সাধারণ একটি বাড়ি মেরামতের সময় আবিষ্কৃত হয়। লুকিয়ে থাকা এ রহস্যময় শহরটি মাটির নিচে প্রায় ২৮০ ফুট গভীরে অবস্থিত। এই শহরটির ছিলো ১৮ টি স্তর। এই স্তরগুলোতে ছিল স্কুল, গীর্জা, রান্নাঘর, গোয়াল ঘর, কবর সহ একটি সম্পূর্ণ শহর। এই শহরটি ৮৫ মিটার গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো এবং এখানে বাস করতে পারতো প্রায় ২০,০০০ এর অধিক মানুষ। মূলত, ১৯৬৩ সালের দিকে এই শহরের ওপরে বাস করা এক অজ্ঞাত ব্যক্তি নিজের বাসায় মুরগি পালতেন। কিন্তু বাসা সংস্কার করার সময় তিনি লক্ষ্য করেন নতুন তৈরি হওয়া এক ছিদ্র দিয়ে তার মুরগিগুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই তিনি ভালো ভাবে অনুসন্ধানের জন্য ওখানে হাল্কা খোড়াখুড়ি করেন এবং লম্বা এক প্যাসেজের সন্ধান পান৷ সাথেই সাথেই এই অঞ্চলে সরকারিভাবে খোড়াখুড়ি করা শুরু হয়। যার বদলৌতে শহরের মাঝে শুকনো খাবার সংরক্ষণের স্থান, বিদ্যালয়, ঘুমানোর স্থান, আস্তাবল সহ সম্পূর্ণ এক সভ্যতার আবাসের তথ্য পাওয়া যায়! আরো পাওয়া যায় ১৮ তলা বিশিষ্ট টানেল। ডেকিংকুয়ো শহরটির প্রাচীন নাম ছিলো এলেংগুবু।
তৎকালে তুরস্কের আনাতোলিয়ার ৩,৩০০ ফুট উঁচু মালভূমিতে অবস্থিত কাপাদোসিয়া ছিল অগ্নুৎপাতের জন্য বিখ্যাত। কয়েক মিলিয়ন বছর আগেও এই এলাকাটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল। সমস্ত এলাকা ডুবে গিয়েছিল ছাই ও লাভায়। পরবর্তীতে এই ছাই ও লাভা পরিবর্তিত হয়ে রূপ নেয় নরম শিলায়। আনাতোলিয়ার প্রাচীন অধিবাসীরা আবিষ্কার করে এই শিলা খোদাই করে ঘর বাড়ি নির্মাণ করা সম্ভব। তারা সেই নরম শিলা খুঁড়ে তৈরি করা শুরু করে ঘরবাড়ি ও আশ্রয়স্থল, মাটির নিচে তৈরি করে শহর। যেন কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ তাদের হানতে না পারে। তাই কাপাদোসিয়াতে মাটির নিচে এমন বহু স্থাপনা তৈরি করে। তবে এদের মধ্যে ডেরিংকুয়ো সবচেয়ে বিশাল ও গভীর হলো। প্রায় ১০০০ হাজার বছরের বেশি এটি ব্যবহার করা হয়েছে৷ অবশেষে ১৯২০ সালে এটিকে পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে রাখা হয়৷ মজার বিষয় হচ্ছে ওই অঞ্চলে ২০০ এর মত এমন ছোট বড় আরো শহরের হদিস পাওয়া গেছে। ধারণা করা হয় সবগুলো শহর টানেলের মাধ্যমে এক সাথে যুক্ত ছিল। যেগুলোর দৈর্ঘ্য ১০০ মাইলেরও অধিক হবে৷
কারা ঠিক কোন সময়ে এই শহরটির নির্মাতা তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি। তবে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ থেকে ১২০০ অব্দে ‘হিত্তিতি’দের রাজত্ব ছিলো আনাতোলিয়ায়। নানা দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের ফলে হিত্তিতি সাম্রাজ্য ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই এলাকায় বলকান থেকে ‘ফ্রিজিয়ান’দের আগমন ঘটে। কেউ কেউ ধারণা করেন, ফ্রিজিয়ানদের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচার জন্যই হিত্তিতিরা ডেরিংকুয়ো নির্মাণ করেছিল। আর হিত্তিতিরা যদি এই শহর তৈরি করে থাকে, তবে তা তারা তৈরি করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দের আগেই। আবার কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, মাটির নিচের এই শহর খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দের মধ্যে ফ্রিজিয়ানরাই তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে মিশরীয়, গ্রীক, আমেরিকান, সিরিয়ান লোকজনের আবির্ভাব ঘটে কাপাদোসিয়ায়। ইতিহাসে লিখিতভাবে গ্রীক সেনা ও ইতিহাসবিদ জেনোফোনের লেখায় কাপাদোসিয়ার এসব ভূগর্ভস্থ শহরের কথা সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বহুকাল ধরে এই অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তার লেখা ‘অ্যানাবেসিস’ নামক বইতে তিনি লিখেছেন, “এখানকার ঘরগুলো ছিল মাটির নিচে। ঘরের প্রবেশের মুখগুলো কুয়ার মতো হলেও নিচে ছিল যথেষ্ট প্রশস্থ। গবাদিপশুর যাতায়াতের জন্য ছিল সুড়ঙ্গ। তবে মানুষ যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতো সিঁড়ি। ঘরগুলোতে ছাগল, ভেড়া, বাছুর সহ বিভিন্ন ধরনের পাখি পোষা হতো এবং প্রতিটি ঘরেই এদের সবার খাবারের ব্যবস্থা ছিল।” অনেকে মনে করেন, বাইজেন্টাইন যুগে ডেরিংকুয়োর বর্ধন ও সংস্করণ করা হয়। তখন এটা ‘মালাকোপিয়া’ নামে পরিচিত ছিল। খ্রিস্টানরা মুসলিম বাহিনীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এখানে আশ্রয় নিতো। এছাড়াও বহু জাতি বিভিন্ন দুর্যোগের সময়ে এটিকে আশ্রয়স্থল হিসাবে ব্যবহার করেছে।
১৯৬৯ সাল থেকে দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় মাটির নিচের রহস্যময় শহর ডেরিংকুয়ো। গোটা শহরের মাত্র ১০ ভাগ দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।