রাসূল (সা.)- এর যুগে হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন

রাসূল (সা.)- এর যুগে হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন


ইসলাম বিশ্বমানবের জন্য আল্লাহ তায়ালা প্রদত্ত এক শাশ্বত ও চিরন্তন জীবনব্যবস্থা। বিশ্বজনীন ও সর্বকালীন আদর্শ হিসেবে এটি মানুষের জন্য আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে বড় উপহার । ইসলামের প্রধান ও প্রাথমিক বুনিয়াদ হলো আল-কুরআন । আল্লাহ তায়ালা তাই নিজেই এর সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কোনো মানবিয় ব্যবস্থার ওপর এর সংরক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত করেননি।

কুরআন নাজিলের পর যে পথ ও পদ্ধতিতে আল-কুরআনের মতো একটি বিশাল মহাগ্রন্থ কল্পনাতীত নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে তাতে আল্লাহ তায়ালার দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু ইসলামকে তার যথার্থ মর্যাদা, তাৎপর্য, মাহাত্ম্য ও গুরুত্বসহ অনুশীলনের জন্য কেবল আল-কুরআনের সংরক্ষণই যথেষ্ট ও ছিল না। এর সাথে সাথেই আল কুরআনের ব্যাখ্যা আল-হাদিসের সংরক্ষণও ছিল অনিবার্য। আল্লাহ তায়ালা আল-হাদিস সংরক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা না দিলেও আল হাদিস সংরক্ষণের যে বিপুল কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে তা পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো মানুষের পক্ষে এ কাজ এত বিশ্বাসযোগ্যভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সম্পাদন করা সম্ভব ছিল না। মূলত আল্লাহ তায়ালার রহমতেই আল-হাদিসের বিপুল সম্পদরাজী সংরক্ষণের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল ।


হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলনের প্রয়োজনীয়তা

হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনব্যাপী কথা ও কাজের মাধ্যমেই ইসলামি জীবনব্যবস্থা বাস্তবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। এ কারণে তাঁর যাবতীয় কথা ও কাজ মুসলিম জীবন দর্শনের মহামূল্যবান সম্পদ। আল হাদিসের শরঈ মর্যাদা এবং আইনকানুন ও হুকুম-আহকাম প্রণয়নে এর ভূমিকার জন্যই আল-হাদিস সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়। উল্লেখযোগ্য কিছু কারণ নিম্নে উল্লেখ করা হল।

১. হাদিসের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা:

আল-হাদিস হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা ও কাজের সমষ্টি। এর মধ্যে কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যায় তিনি যা বলেছেন তা বিবৃত হয়েছে। বিবৃত হয়েছে সাহাবা (রা.) ও অন্যান্যদের জিজ্ঞাসার জবাবে। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) দীনের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে যা বলেছেন তাও আল-হাদিস ইসলামি আইনের দ্বিতীয় উৎস। একে সংরক্ষণ করা না হলে মানুষ এর বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়বে। সে জন্যই আল হাদিস সংরক্ষণ অনিবার্য ছিল।

২. ফরজ কাজ সম্পাদন:
আল-হাদিসের সহযোগিতা ছাড়া একটি ফরজ কাজও যথাযথভাবে সম্পাদন করা সম্ভব নয় । কুরআন মাজীদে মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। তা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সে সম্পর্কে বিবরণ আছে আল-হাদিসে। আল-হাদিস তাই ফরজ কাজ সম্পাদনের গাইড লাহন । আল হাদিস সংরক্ষণ ছাড়া এ গাইড লাইন অনুসরণ করা সম্ভব ছিল না বলেই আল হাদিস সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় ছিল।

৩. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অনুসরণ:

আল-হাদিস মূলত হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনযাপনের বাস্তব প্রতিকৃতি। আল- হাদিসে তাই স্থান পেয়েছে যা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) করেছেন বা বলেছেন। আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজীদ নাজিল করেছেন আর আদেশ দিয়েছেন আল কুরআন মেনে চলার জন্য রাসূল (সা.)-কে অনুসরণ করতে। কেননা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন এক জীবন্ত কুরআন। বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী এ মহামানবের জীবন দর্শন, কাজ ও কথা আল-হাদিসে বিবৃত হয়েছে। তাঁর অনুসরণ করার জন্য আল-হাদিস সংরক্ষণ করা ছাড়া উপায় ছিল না ।

৪. হাদিস জাল প্রতিরোধ:
রাসূল (সা.)-এর হাদিস এমন নয় যে তা জাল করা যায় না বরং আরবি ভাষাভাষি যে কেউ হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামে হাদিস বানাতে পারে। এভাবে যে কেউ যদি তাদের স্বার্থের অনুকূলে হাদিস জাল করা শুরু করে তাহলে মূল হাদিস গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারে। অথচ যদি জাল হাদিস থেকে আল-হাদিস পৃথক করা সম্ভব না হয় তাহলে মানবতার মুক্তির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। জাল হাদিসের কবল থেকে আল-হাদিসকে রক্ষা করার জন্য তাই হাদিস সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় ছিল ।

৫. দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ দলিলের বিলুপ্তি রোধ:
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যা করেছেন, যা বলেছেন তা দ্বীনের পক্ষের গুরুত্বপূর্ণ দলিল । সংরক্ষণ করা না হলে এ দলিল বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বিধায় হাদিস সংরক্ষণ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

৬. আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ:
হাদিস মেনে চলার, হাদিসের অনুসরণ ও অনুশীলন করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। এ নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন-

“আর রাসূল তোমাদের যা দেন তা গ্রহণ করো এবং যা হতে তোমাদের নিষেধ করে- তা থেকে বিরত থাকো।” (সূরা হাশর : ৭)

যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা না হলে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মেনে চলা যাবে না বিধায় হাদিস সংরক্ষণ অনিবার্য হয়ে ওঠে।


৭. শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস:
আল-কুরআন ইসলামি শরিয়তের প্রথম এবং প্রধান উৎস। কেননা এ হলো আল্লাহ তায়ালার প্রত্যক্ষ ওহি। হাদিস এ শরিয়তের দ্বিতীয় উৎস। কারণ আল্লাহ তায়ালার ওহি হলেও তা প্রত্যক্ষ ওহি নয়। এ হলো এক পরোক্ষ ওহি। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মানুষের উপযোগী করে এ ওহি নিজস্ব ভাষায় পরিবেশন করেছেন। তা ছাড়া এ হলো তার বক্তব্য ও জীবনাদর্শ। এর মর্যাদা বহাল রাখা এবং বাস্তবজীবনে অনুশীলনের জন্যই হাদিস সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় ছিল।

৮. আল-কুরআনের তাফসির:
হাদিস হলো আল-কুরআনের সংক্ষিপ্ত মূলনীতিসমূহের ব্যাখ্যা। কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা দানের এ দায়িত্ব নিয়েই হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আবির্ভূত হয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِكرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
অর্থাৎ, “আর আপনার নিকট আমি আল-কুরআন নাযিল করেছি। যেন মানুষের সামনে আপনি সে সকল বিষয় বর্ণনা করেন, যেগুলো তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যাতে তারা চিন্তাভাবনা করে।”

(সূরা নাহল : ৪৪)

সাহাবা (রা.) গণ আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াত ও বিধান সম্পর্কে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করেছেন। তিনি হাদিসে তার জবাব দিয়েছেন । এভাবে হাদিস পরিণত হয়েছে কুরআন মাজীদের ব্যাখ্যা গ্রন্থে। কুরআন-মাজীদের অর্থ ও তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গমের জন্যও হাদিস সংরক্ষণ প্রয়োজনীয় ছিল ।

৯. রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রবর্তিত বিধান:

কুরআন মাজীদে সকল ব্যবহারিক বিষয়ের বিস্তারিত বিধান দেওয়া হয়নি। কেবল মূলনীতি পেশ করা হয়েছে। ব্যবহারিক দিকের প্রয়োজনীয় বিধান প্রবর্তনের অধিকার দেওয়া হয়েছে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে।
আল্লাহ বলেন-

“রাসূল তাদেরকে ভালো কাজের আদেশ করেন, আর তাদেরকে খারাপ কাজে বিরত থাকতে নিষেধ করেন। তাদের জন্য তিনি ভালো ও উৎকৃষ্ট হালাল করেন এবং নিকৃষ্ট ও মন্দ কাজ হারাম করেন।”
(সূরা আরাফ : ১৫৭)

রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রণীত এসব বিধিবিধানের প্রামাণ্য দলিল হলো হাদিস। এ দলিল সংরক্ষণ করা না হলে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রবর্তিত বিধান সম্পর্কে জানা যেত না ।

১০. রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যের উপায়:
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য । আল্লাহ তায়ালা বলেন-

“তুমি বলো, তোমরা আল্লাহ তায়ালার ও রাসূলের আনুগত্য করো। যদি তোমরা এর থেকে বিমুখ হও, তাহলে আলাহ তায়ালা অবশ্যই কাফিরদের ভালোবাসেন না।”
(সূরা আলে ইমরান : ৩২)

কুরআন মাজীদের পাশাপাশি হাদিসের পূর্ণ অনুসরণ ও অনুশীলনই হলো রাসূল (সা.)-এর আনুগত্যের অবিকল্প উপায় । হাদিস সংরক্ষণ করা না হলে এ আনুগত্য করা সম্ভব হতো না ।

১১. রাসূল (সা.) এর প্রতি প্রেমের নিদর্শন:
হাদিস মেনে চলা, অনুসরণ ও অনুশীলন করা আল্লাহ তায়ালার প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোভাসারই নামান্তর। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যে আমার হাদিসকে ভালোবাসে, সে ভালোবাসে আমাকেই। আর যে আমার হাদিস থেকে বিমুখ হয় সে আমাদের দলভুক্ত নয়।” রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা পোষণ ও প্রদর্শনের স্বার্থে তাই হাদিস সংরক্ষণ জরুরি ছিল।

১২. জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎস:
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ছিলেন বিশ্ব মানবতার মহান শিক্ষক। তিনি ছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের পূর্ণ আধার । আল্লাহ তায়ালা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তাঁকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী মানুষে পরিণত করেন। যে জন্য রাসূল (সা.)-এর বাণী মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের প্রয়োজনীয় জ্ঞানের এক নির্ভরযোগ্য উৎস ছিল। একে সংরক্ষণ করা না হলে জ্ঞানবিজ্ঞানের দ্বিতীয় প্রধান উৎসটি হারিয়ে যেত।

১৩. ঐতিহাসিক দলিল:
ইতিহাসের প্রমাণ্য উৎস হাদিস। স্বাভাবিকভাবেই হাদিসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্রতম জীবন ও চরিত্র সংরক্ষিত ছিল। সমকালীন মানুষের চিন্তা-ভাবনা, রুচি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, সাধনা প্রভৃতির বিবরণত হাদিসের অন্তর্ভূক্ত ছিল। পূর্ববর্তী নবী-রাসূল ও তাদের উম্মতদের জীবনযাত্রার নির্ভরযোগ্য বিবরণ আছে হাদিসে। তা ছাড়া হাদিস সংরক্ষণ, সংগ্রহ, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ পরবর্তীকালের মানুষের কাছে ইতিহাস চর্চার নিবন্তর প্রেরণা হয়ে ওঠে। হাদিস সংরক্ষিত না হলে এ দলিল কালের অতল গহ্বরে বিলিন হয়ে যেত ।

১৪. ইসলামের পূর্ণতার দলিল:
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা।আল্লাহ তায়ালা এর পূর্ণতা ঘোষণা করে বলেছেন-

“আজ তোমাদের জন্য আমি তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নিআমত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।”
(সূরা মায়িদা : ৩)

হাদিস হলো ইসলামি পূর্ণতার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। গতিশীল মানবজীবনে প্রতিনিয়ত উদ্ভূত নানা সমস্যার যৌক্তিক সমাধানের পথ উন্মুক্ত রেখে হাদিসই ইসলামকে পরিপূর্ণতার মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। হাদিস সংরক্ষণ করা না হলে ইসলামের পূর্ণতার বিষয়টি অনিবার্যভাবে প্রমাণ হওয়া সংশয়াপন্ন হয়ে যেত।

প্রকৃতপক্ষে হাদিস সংরক্ষণ করা না হলে জীবনব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম এবং তার অনুসারী হিসেবে বিশ্বমানবের পথপ্রদর্শক, সৎকাজে আদেশদাতা এবং খারাপ কাজে নিষেধকারী হিসেবে মুসলমানদের কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। হাদিসের সংরক্ষণই এ বিষয়গুলো সম্ভব করে তুলেছে। কাজেই যেকোনো বিবেচনায় হাদিস সংরক্ষণ আল-কুরআন সংরক্ষণের মতোই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজ ছিল।


রাসূল (সা.) যুগে হাদিস সংরক্ষণ ও সংকলন

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবদ্দশায় হাদিস সংকলন বাস্তব কারণেই সম্ভব ছিল না। আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে কুরআন মাজীদ গ্রন্থাবদ্ধ হলে হাদিস সংকলনের পথ প্রশস্ত হয় । খুলাফা-ই-রাশেদীনের স্বর্ণযুগে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংকলনের কিছু বিচ্ছিন্ন উদ্যোগও নেওয়া হয়। প্রথম খলিফা আবু বকর (রা.) নিজে পাঁচশত হাদিসের একখানা সংকলন তৈরি করেন। পরে অবশ্য নিজেই তা বিনষ্ট করে দেন। উমর (রা.) শাসনকার্য পরিচালনার জন্য হাদিস লিপিবদ্ধ করে শাসকদের নিকট প্রেরণ করতেন । আলী (রা.) খলিফা অবস্থায় সহিফা নামে একটি সংক্ষিপ্ত হাদিস গ্রন্থ লেখেন। কিন্তু হাদিসের সর্বজনীন ও ব্যাপক সংকলন এ সময়ে শুরু হয়নি। হাদিসের ধারক-বাহক হওয়ার কারণে সাহাবা (রা.) গণ ও গ্রন্থাকারে হাদিস সংকলনের কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। যে জন্য হিজরি প্রথম শতাব্দীতে হাদিস সংকলনের কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি। যে জন্য হিজরি প্রথম শতাব্দীতে হাদিস সংকলনের কোনো ব্যাপক উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। হিজরি প্রথম শতকে হাদিস সংকলনের কোন ব্যাপক উদ্যোগ গৃহীত না হওয়ার অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। এ শতাব্দীর তৃতীয় দশক পর্যন্ত হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবিত ছিলেন। এ সময় পর্যন্ত তাঁর কোনো বাণী বা নির্দেশনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অবকাশ ছিল না।কোন বিষয়ে মতদ্বৈতা দেখা দিলে তাঁর সাহাবাগণ (রা.) সরাসরি তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। আইনের কোনো বিষয় অস্পষ্ট বা একাধিক সমাধান সম্ভাবনাপূর্ণ থাকলে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে তারা এ সমাধান গ্রহণ
করতে পারতেন। ফলে সংকলিত হাদিস গ্রন্থের প্রয়োজনীয়তা এ সময়ে একেবারেই ছিল না।


হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লিখিত হাদিসসমূহ:
হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তায়ালার বাণীর ব্যাখ্যায় বা অনুসারী সহচরগণের জিজ্ঞাসার জবাবে যে বাণী প্রদান করতেন, কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে যে কাজ করতেন কিংবা কোনো সাহাবিকে যে কাজ করার অনুমতি দিতেন, যে কথা সমর্থন করতেন আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর জলীলুল কদর সাহাবিগণ তা অত্যন্ত সতর্কতা ও নিষ্ঠার সাথে সংরক্ষণ করতেন। আল হাদিসের বিশাল সম্ভার মূলত সাহাবিগণের এ চেষ্টারই ফলশ্রুতি। এর বাইরে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজস্ব তত্ত্বাবধায়নে বেশ কিছু হাদিস লিখে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এগুলো ছিল মূলত হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বিভিন্ন ফরমান, চিঠি, নিরাপত্তানামা, চুক্তিমানা ইত্যাদি। আল-হাদিসের গবেষকগণ নিরলস চেষ্টায় হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে লিখিত এ রকম কিছু হাদিস শনাক্ত করেছেন। এখানে এ জাতীয় হাদিসসমূহের একটি তালিকা উল্লেখ করা হলো-

১. তামীম দারীর পরওয়ানা:
হিজরতের আগে মক্কায় অবস্থানকালে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তামীম দারিকে একটি পরওয়ানা প্রেরণ করেন এটি লিখিত ছিল। সহিহ মুসলিম ও মুআত্তা ইমাম মালিক গ্রন্থে এ পরওয়ানা সংকলিত হয়েছে ।

২. সুরাকার নিরাপত্তানামা: মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে হিজরতের পথে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে ধরার উদ্দেশ্যে আসা সুরাকা ইবনে মালিক (রা.) মুদলিজীকে একটি নিরাপত্তানামা লিখে দিয়েছিলেন। হযরত ইবনে কাসীর (রা.) ‘আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে এর বিবরণ উল্লেখ করেছেন। সুরাকা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন-
“আমার নিরাপত্তার জন্য আপনি একটি দলিল লিখে দিন, এটি আমার ও হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মধ্যে মুক্তির সিন্ধান্তের প্রমাণ হিসেবে থাকবে না।”
তাঁর আবেদনের ভিত্তিতে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাড় বা পাতা বা ছেঁড়া কাপড় জাতীয় একটি পত্রে সুরকার জন্য নিরাপত্তানামা তৈরি করে দিলেন।

৩. মদিনা সনদ: মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনার খ্রিস্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও মুসলিমদের সমন্বয়ে একটি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ গঠন ও মদিনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সকলের সমন্বয়ে ৪৭ বা ততধিক ধারা বিশিষ্ট শাসন সনদ তৈরি করেন। এটি সভ্যতার ইতিহাসের প্রথম লিখিত শাসন সনদ, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশে লেখকগণ এটি লিপিবদ্ধ করেন। ইবনে হিশামের ‘সীরাত’ গ্রন্থে সনদের বিস্তারিত বিবরণ সংকলিত হয়েছে।
হযরত রাফি ইবনে খাদীজ (রা.) বলেছেন-
“মদিনা সনদে মদিনাকে নিরাপদ নগরী ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের নিকট চুক্তিনামাটি খাওলানী চামড়ায় লিখিত আছে।”

৪. বনু জামরার চুক্তি: হিজরি তৃতীয় সনের সফর মাসে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বানু জামরা গোত্রের সাথে একটি লিখিত সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তিমালা লিখিত অবস্থায় পাওয়া গেছে। সহিহ বুখারীতে এর ভাষা সংকলিত হয়েছে ।

৫. আদমশুমারি ফরমান: মদিনায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল মানুষের ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে সকল লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের একটি জীব আদমশুমারী গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটি একটি লিখিত নির্দেশ ছিল।

হযরত হুযাইফা (রা.) বর্ণনা করেন- “এ নির্দেশ পেয়ে আমরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এক হাজার পাঁচশত ব্যক্তির নাম ও পরিচয় লিখে পেশ করি।”
সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে এ সংক্রান্ত বিবরণ সংকলিত হয়েছে।

৬. হুদায়বিয়ার সন্ধি: হিজরতের ষষ্ঠ বছর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মুতাবিক ১৪শত অনুসারী সাহাবি তাঁর নিয়ে মক্কায় হজ পালন করতে যান। কিন্তু কুরাইশদের অন্যায় বাধার কারণে তিনি হজ করতে ব্যর্থ হন। আলোচনা, উত্তেজনা, ষড়যন্ত্র, চোরাই হামলা ইত্যাদি নানা পর্যায় পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত কুরাইশরা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে একটি লিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এ চুক্তি ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়া সন্ধি’ নামে খ্যাত। দশবছর মেয়াদি এ চুক্তি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনাক্রমে হযরত আলী (রা.) লিপিবদ্ধ করেন। শর্তসহ এ চুক্তিনামা লিখিত অবস্থায় সংরক্ষিত ছিল। [সূত্র : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া]

৭. শাসকবর্গকে লিখা চিঠি: হুদায়বিয়ার সন্ধির পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলাম প্রচারের এক অভূতপূর্ণ পরিবেশ লাভ করেন। ইসলাম প্রচার শুরুর উনিশ বছর পর নির্যাতন ও আক্রমণের আশঙ্কাহীন অবস্থায় ইসলাম প্রচারকগণ আরবের বিভিন্ন এলাকায় ইসলাম প্রচারে সুযোগ পান। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সুযোগে সমকালীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শাসকবর্গের নিকট ইসলাম গ্রহণের আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেন। তিনি হাবশার বাদশা নাজ্জাশী, রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াস, পারস্যের সম্রাট খসরু পারভেজ, মিশর ও আলেকজান্দ্রিয়ার শাসক মুকাওয়াকাস, আম্মানের বাদশাহ যুফার ও আব্দুলাহর নিকট দূত পাঠিয়ে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান সম্বলিত লিখিত দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন। এ সকল দাওয়াতনামার ভাষা ও তথ্য হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সরাসরি নির্দেশনায় লিখিত হয়েছিল। [সূত্র : আবু উবাইদ, কিতাবুল আমওয়ালা]

৮. লাইস গোত্রের ভাষণ: হিজরতের অষ্টম বছর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা বিজয়ের পর বনু খুজায়া গোত্রের লোকেরা বনু লাইস গোত্রের এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। এ সংবাদ পাওয়ার পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ বাহনের পিঠে আরোহী অবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দান করেন। ভাষণে তিনি হারাম শরীফের মর্যাদা, মানুষ হত্যার দণ্ড, দিয়াত ইত্যাদি বিষয়ক আহকাম বর্ণনা ধরেন। তার ভাষণ শেষ হলে হযরত আবু শাহ (রা.) ভাষণটি লিখে দেওয়ার জন্য হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে অনুরোধ করেন । তার অনুরোধে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিগণকে আদেশ দেন, ভাষণটি লিখে আবু শাহকে দেওয়ার জন্য। [সহিহ বুখারী]
আল্লাহর রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.) -এর আদেশে এ ভাষণটি লিখে আবু শাহকে দেওয়া হয়।

৯. আরব কাবিলাকে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ও প্রয়োজনে আরবের বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন কাবিলার প্রতি নানারকম আদেশ-নিষেধ, উপদেশ, নির্দেশনা লিখে ফরমান প্রেরণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর এ সকল ফরমানও লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়। [সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল]

১০. হজবিধি: হিজরতের নবম বছর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আবু বকর ইবনে কুহাফা (রা.)-কে আমীরুল হজ করে মক্কায় প্রেরণ করেন। হজের নিয়মকানুন যেন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় সে কারণে তিনি হজের নিয়ম-পদ্ধতিসমূহ লিখে হযরত আবু বকর (রা.) – কে লিখিত আকারে দান করেছিলেন। [সূত্র : ইবনে হিশাম, সিরাত]

১১. কাবার পবিত্রতা ফরমান: সুরা তাওবা নাজিল হওয়ার পর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (রা.)-কে একটি লিখিত ফরমানসহ মক্কা প্রেরণ করেন। হজের সময় লোকদেরকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য এ ফরমানে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) উল্লেখ করেন : “এ বছরের পর আর কোনো মুশরিক কাবা ঘরের নিকট যেতে পারবে না। কেউ নগ্ন হয়ে তাওয়াফ করতে পারবে না । জান্নাতে কেবল মুমিন লোকেরাই প্রবেশ করতে পারবে। প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতি পালনে বাধ্য থাকবে।” [ইবনে হিশাম, সীরাত ]

১২. বিভিন্ন গোত্রের জন্য লিখিত আহকাম: হিজরতের অষ্টম বছর মক্কা বিজয়ের পর থেকে মদিনায় আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে নানা গোত্র-উপগোত্র সরাসরি অথবা প্রতিনিধি প্রেরণ করে ইসলাম গ্রহণ করে। এ সকল গোত্র নিজেদের প্রয়োজনে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট থেকে প্রয়োজনীয় নানা আহকাম লিখিয়ে নেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ক হুকুম-আহকাম লিখে দেন। সকল লিখাই তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধায়নে সম্পন্ন হয় ।

১৩. সাহাবিগণের পত্রের উত্তর: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতিনিধি হিসেবে অনেক সাহাবি আরব আযীমের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)ও অনেককে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেন। এ সকল সাহাবিগণ প্রচারের কাজে বিভিন্ন জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হন। তাঁরা সে সকল জিজ্ঞাসা সম্বলিত চিঠি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকট প্রেরণ করেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) চিঠির মাধ্যমে এ সকল সমস্যার সমাধান দান করেন। এগুলো ও লিখিত আকারে সংরক্ষিত হয় এবং বিভিন্ন সীরাত ও হাদিসগ্রন্থে সংকলিত হয়।

১৪. আব্দুলাহ ইবনে হাকীমকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু সম্পর্কিত আহকাম লিখিয়ে হযরত আব্দুলাহ ইবনে হাকীম (রা.)-এর নিকট প্রেরণ করেন। [সূত্র : তাবারানী]
এ চিঠির ভাষ্যে মৃত জন্তু সম্পর্কিত বিধানের অন্যতম উৎস বিবেচিত হয় ৷

১৫. ওয়ায়িল ইবনে হাজারকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশিষ্ট সাহাবি হযরত ওয়ায়িল ইবনে হাজার (রা.)-কে দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু আহকাম লিখিয়ে দেন। এতে সালাত, মদপান, সুদ ইত্যাদি বিষয়ের মৌলিক বিধিসমূহ লিখিত ছিল। [সূত্র : তাবারানী]

১৬. ইবনে সুফিয়ানকে হিদায়তনামা: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বামীর পক্ষ থেকে স্ত্রী কর্তৃক রক্তপাতের দিয়ত বা বদলা আদায়ের বিধান লিখিত একখানা হিদায়াতনামা হযরত যাহাক ইবনে সুফিয়ান (রা.)-কে দান করেছিলেন। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) তাঁর সংকলনে এ সংক্রান্ত বিবরণ সংকলন করেছেন। [সূত্র : সুনানে আবু দাউদ]


১৭. ফসলের যাকাত সংক্রান্ত ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের নওমুসলিমদেরকে বিভিন্ন ধরনের ফসলের যাকাত আদায়ের বিধান সম্পর্কে অবহিত করার জন্য একখানা লিখিত ফরমান প্রেরণ করেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত সাহাবি (রা.) এ ফরমান অনুসারে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা করেন। [সূত্র : নাইলুল আওতার]

১৮. ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের অধিবাসীদের নিকট আরেকখানা লিখিত ফরমান প্রেরণ করেন। এতে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মধ্যে যারা ইসলাম গ্রহণ করবে তারা মুসলমান বলে গণ্য হবে। তারা মুসলমানদের মতোই সকল অধিকার ভোগ করবে এবং অর্পিত দায়িত্বসমূহ পালন করবে। আর যদি কেউ মুসলিম না হয় সে সুযোগও থাকবে। তারা স্ব স্ব ধর্ম পালন করবে। অবশ্য এ জন্য তাদেরকে জিযিয়া আদায় করতে হবে। [সূত্র : কিতাবুর আমওয়াল]

১৯. হুযাইফা (রা.)-কে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যাকাতের আহকাম সংক্রান্ত একখানা ফরমান হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান (রা.)-কে লিখে দেন। যাকাতের সংশ্লিষ্ট বিধানের ক্ষেত্রে হুযাইফা (রা.) সবসময় এ ফরমান মেনে চলেছেন। [সূত্র :তাবাকাত ইবনে সাদ]

২০. বনু সাকীফের সন্ধিনামা: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বনু সাকীফের প্রতি একখানা সন্ধিনামা লিপিবদ্ধ করে একজন সাহাবি বার্তাবাহকের মাধ্যমে তা প্রেরণ করেন। সন্ধিনামার শুরুতেই তিনি লিখে দেন। সাকীফ গোত্রের জন্য এটি রাসূলুল্লাহ (সা.) লিখিত সন্ধিনামা। [সূত্র : আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া]

২১. কিতাবুল জিরাহ: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনবাসীর জন্য উটের চামড়ায় একখানা ঘোষণাপত্র লিখে দেন। এটি ‘কিতাবুল জারাহ’ নামে খ্যাত হয়। হাফিজ ইবনে কাসীর (রা.)-এর বর্ণনানুসারে, কিতাবুল জারাহ নেতৃস্থানীয় সাহাবিগণের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হতো। তাঁরা বিভিন্ন ফায়সালায় এর অনুসরণ করতেন এবং এর মোকাবিলায় নিজেদের রায় পরিত্যাগ করতেন। [সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল]

২২. মুআয (রা.)-কে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) অন্যতম সাহাবি হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-কে সাদাকা সম্পর্কিত একখানা ফরমান বা চিঠি লিখে দেন। হযরত মূসা ইবনে তালহা বলেন- “আমাদের নিকট মুআয ইবনে জাবাল (রা.)-এর নিকট প্রেরিত হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সে পত্রখানা রক্ষিত রয়েছে।” [সূত্র : মিশকাত]

২৩. ইবনে আকসা সুলামীকে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত উমর ইবনে আকসা সুলামী (রা.)-কে একখানা ফরমান লিখে পাঠান। ফরমানে তিনি সদকার বিধান এবং জীব-জন্তুর যাকাত সম্পর্কিত আহকাম লিখে দেন ৷

২৪. গালিব (রা.)-কে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত গালিব ইবনে আব্দুলাহ (রা.)-কে একখানা ফরমান লিখিয়ে প্রেরণ করেন । এ ফরমানে তিনি গণীমতের মাল বণ্টন, ব্যবহার, ভোগ ও উপার্জন সম্পর্কে আলোকপাত করেন ।

২৫. সুমামা (রা.)-এর প্রতিনিধি দলকে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একজন মুমিনের জন্য অবশ্য পালনীয় ফরজ বিধানসমূহ ও সাদাকাতের হুকুম-আহকাম লিখিয়ে হযরত সুমামা (রা.)-এর প্রতিনিধি দলকে দান করেন।

২৬. আবু রাশীদ (রা.)-কে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সালাত আদায়ের পর্যায় ক্রমিক নিয়ম-কানুন ও শরঈ হুকুম আহকাম লিখিয়ে হযরত আবু রাশীদ আযদী (রা.)-কে প্রদান করেন ।

২৭. নাজরানের পাদ্রীকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নাজরানের একজন খ্রিস্টান পাদ্রীর নিকট একখানা লিখিত দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন । এতে তিনি ইসলাম ও ইসলামের দাওয়াত সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য উল্লেখ করেন এবং জিযিয়ার আহকামও সংযুক্ত করেন।

২৮. হাজারামাউতের শাসককে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় হাজরা মাউতের শাসকের জন্য সালাত, যাকাত ও গণিমতের মালের বিবরণসহ একখানা চিঠি প্রেরণ করা হয়েছিল।

২৯. জিযিয়া ও যাকাতের পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় দুমাতুল জান্দালের অধিবাসীদেরকে জিযিয়া ও যাকাতের বিধান অবহিত করে একখানা চিঠি প্রেরণ করা হয়। এতে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান ছিল।

৩০. উশর সম্পর্কিত পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কুতন ও দুমাতুল জান্দালের অধিবাসীদেরকে উশরের হুকুম-আহকাম লিখিয়ে একখানা পত্র প্রেরণ করা হয়।

৩১. হাররা ও আজরাহ কবিলাসমূহকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হাররা ও আজরাহ কাবিলাসমূহের নামে জিযিয়া সংক্রান্ত আহকাম লিখে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

৩২. বনু নাহাদ কাবীলাকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বনু নাহাদ কবিলার লোকদের জন্য যাকাতের পশু আদায়ের হুকুম-আহকাম লিখে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।

৩৩. হাজারের অধিবাসীদের প্রতি ফরমান: হাজারের অধিবাসীদের প্রতি হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) এক ফরমান লিখে পাঠান। ফরমানে তিনি হাজারের অধিবাসীদের ইসলামের ওপর সুদৃঢ়ভাবে টিকে থাকার এবং নিজ শাসকদের আনুগত্য করার নির্দেশ দান করেন। [সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল]

৩৪. বানু হানিফা কাবীলাকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বনু হানিফা কবীলাকে জিযিয়ার নিয়ম-কানুনসহ একখানা পত্র প্রেরণ করেন। পরে জিযিয়া দেওয়ার আহ্বানের আগে যথারীতি ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি ।

৩৫. আয়লা ও ইউহানাবাসীকে আমলনামা: হযরত রাসূলাহ (সা.)-এর নির্দেশে আয়লা ও ইউহানাবাসীকে একখানা আমলনামা লিখে দেওয়া হয়েছিল।

হাফিজ ইবনে কাসীর লিখেছেন, এ আমলনামার শুরুতে লিখা ছিল-
“বিসমিলাহির রাহমানির রাহীম” এটি আল্লাহ তায়ালা ও আল্লাহর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পক্ষ থেকে ইউহানা ও আয়লবাসীর জন্য একখানা আমানত।
[সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল]


৩৬. বনু ইয়ারককে পত্র: বনু ইয়ারক গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল মদিনায় এলে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় তাদেরকে জমিতে উৎপন্ন ফসল ও চারনভূমি সম্পর্কে ইসলামের বিধান লিখে দেওয়া হয় ।

৩৭. তামীম দারীর কাবীলাকে পত্র: কারো হাদিয়া উপহার গ্রহণ করার ইসলামি বিধান কী এবং সোনার তৈরি আসবাবপত্র ও তৈজসপত্র ব্যবহারের শরঈ নীতিমালা কী তা লিখে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তামীম দা’রীর কবিলার নিকট প্রেরণের ব্যবস্থা করেছিলেন।

৩৮. আম্মানের শাসনকর্তাকে পত্র: আম্মানের শাসক যুফার এবং আব্দুলাহকে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পত্র দিয়েছিলেন ইসলাম গ্রহণের দাওয়াতে দিয়ে। পাশাপাশি চিঠিতে দাওয়াত, যাকাত ও উশর সম্পর্কীয় মাসাইলও লিখে দেওয়া হয়।

৩৯. ইবনে জামাদকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলামের রুকনসমূহ লিখে একখানা শিক্ষামূলক পত্র প্রেরণ করেন খালিদ ইবনে জামাদকে। চিঠিতে রুকনসমূহ পালনের আবশ্যকতা সম্পর্কেও আলোকপাত করা হয় ।

৪০. ইবনে সাইফকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় জুরআ ইবনে সাইফকে জিযিয়া ও যাকাতের হুকুম-আহকাম লিখে দেওয়া হয়।

৪১. রাবীয়াকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় যাকাত, উশর, খারাজ ইত্যাদি বিষয়ে একখানা পত্র রাবীয়া ইবনে যী মারহাব হাজরীকে প্রদান করা হয় ৷

৪২. ওরাহবিল ও অন্যান্যদেরকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) গণিমতের অর্থ-সম্পদ বণ্টনের আহকাম এবং উশর ও যাকাতের মাসয়ালা লিখে শুরাহবিল, হারিস, নুআইম, বনু আবদু কালান প্রমুখের নিকট প্রেরণ করেন ।

৪৩. ফল পাকার পূর্বে বিক্রি সংক্রান্ত ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সমকালে আরবে পাকার আগে ফল বিক্রির রীতি প্রচলিত ছিল। এ বিষয়ে ইসলামের বিধান সকলকে অবহিত করার জন্য হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি ফরমান জারি করেন। ফরমানে তিনি মুসলিম জনগণের জন্য ফল পাকার আগে বিক্রি করা এবং বায়তুল মালের প্রাপ্য এক-পঞ্চমাংশ আদায়ের আগে গণিমাতের মাল থেকে মুজাহিদদের নিজেদের অংশগ্রহণ করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান উল্লেখ করেন ।

৪৪. ইবনে খালিদকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো পণ্য বিক্রি করার আগে পণ্যের দোষ-ত্রুটি বিক্রেতার কাছে প্রকাশ করার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে হযরত আদা ইবনে খালিদকে একখানা বক্তব্য লিখে দেন।

৪৫. উমর (রা.)-কে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় আল-ফারুক হযরত উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-কে সাদাকাতের বিধিবিধান বিস্তারিতভাবে লিখে দেওয়া হয়েছিল।

৪৬. আবু বকর (রা.)-কে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় আস- সিদ্দীক হযরত আবু বকর ইবনে কুহাফা (রা.)-কে যাকাতের যাবতীয় হুকুম আহকাম লিখে দেওয়া হয়েছিল।

৪৭. তামীম দারীকে জমি দান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইসলাম কবুলের পর তামীমদারীকে তার নিজ গ্রামের একখণ্ড জমিন লিখে দেন। হযরত তামীম দলিলখানা সংরক্ষণ করেন। হযরত উমর ফারুক ইবনে খাত্তাব (রা.) খলিফা হওয়ার পর তামীম (রা.) এ দলিলখানা খলিফার নিকট পেশ করেন। খলিফা তাঁর নামেই জমিনখণ্ড বরাদ্দ দেন।

৪৮. মাজ্জায়া ও আবু সালাবাকে জমি দান: হযরত রাসূলুলাহ (সা.) লিখিতভাবে মাজ্জায়া ইয়ামানী ও আবু সালাবা আল- খুশানীকে দুইখণ্ড জমি দান করেন। তারাও আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর লিখিত দলিল সংরক্ষণ করেন।

৪৯. ইবনে কাহিনকে পত্র: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) মুতাররফ ইবনে কাহিন বাহিলীকে একখানা পত্র প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। পত্রে বিশেষভাবে যাকাতের হুকুম আহকাম লিখে দেওয়া হয়।

৫০. ইবনে সাবীহকে পত্র: মুনযির ইবনে সাবীহকে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় জিযিয়ার মাসআলা লিখে একখানা পত্র দেওয়া হয় । এতে অগ্নিপূজকদের প্রতি ইসলামের ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনাও অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

৫১. আকীদর বংশের প্রতি ফরমান: আকীদর বংশের লোকদের আল্লাহর রাসূর (সা.) একখানা ফরমান লিখে দেন। বিশেষ কারণে এ ফরমানখানা গুরুতপূর্ণ ছিল। তখনও নবুয়তী সীল মোহর তৈরি না হওয়ায় এই ফরমানে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আঙ্গুলের ছাপ লাগানো হয়েছিল। [সূত্র : আল – ইসাবা]

৫২. কাযযাবের প্রতি ফরমান: মুসাইলামা কাযযাব ছিল সেই সব দুর্ভাগা লোকদের শীর্ষতম, যারা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দৰ্শন পেলেও হিদায়াত লাভ করতে পারেনি। উল্টো হিদায়াতকে চ্যালেঞ্জ করে চিরদিনের জন্য ধ্বংস ও অভিশাপে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। মুসাইলামা ছিল নবুয়তের মিথ্যা দাবিদার। এ রকম ভয়ানক মিথ্যার জন্য তার নামের সাথে কাযযাব বা চরম মিথ্যাবাদী অভিযুক্ত করা হয়। তার বিভ্রান্তি, মিথ্যা দাবি, দাবির অসারতা ইত্যাদি বিষয়সহ তাকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পক্ষ থেকে একটি ফরমান জারি করা হয়। এ ফরমানটির একখানা আলোকচিত্র ১৮৯৬ সালে লন্ডনের পিকচার ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

৫৩. খায়বরের ইহুদিদের প্রতি পত্র: খায়বরের ইহুদি অধ্যুষিত অঞ্চলে হযরত আব্দুলাহ ইবনে সাহল (রা.)-কে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে হযরত (রা.) খায়বরের ইহুদিদেরকে তাঁর মৃত্যুপণ বা দিয়ত পরিশোধের নির্দেশ দিয়ে একখানা পত্র প্রেরণ করেন। [সূত্র : ইবনে হিশাম, সীরাত]

৫৪. মধুর যাকাত বিষয়ক ফরমান: ইয়েমেনে মধু চাষ হতো মধুর যাকাত দিতে হবে কিনা, শুধু উশরের আওতায় আসবে কিনা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে নানাবিধ সংশয় তৈরি হয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনের অধিবাসীদের জন্য মধুর যাকাত সম্পর্কিত ফরমান লিখে প্রেরণ করেন। [সূত্র : দিরায়া ফী তাখরীজে আহাদীসিল হিদায়া]

৫৫. নগদ অর্থ ও সোনার যাকাত বিষয়ক ফরমান: ইয়েমেনের মুআয বিন জাবাল (রা.)-কে শাসক নিযুক্ত করেছিলেন। শাসন কাজের সুবিধার জন্য হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁকে নগদ অর্থ ও সোনার যাকাত সম্পর্কিত বিধান লিখে প্রেরণ করেন।

ফরমানে তিনি লিখেন-
প্রতি দুশত দিরহাম থেকে পাঁচ দিরহাম আর কুড়ি মিসকাল থেকে অর্ধ্ব মিসকাল সোনা যাকাত হিসেবে গ্রহণ করবে।
[সূত্র : দিরায়া ফী তাখরীজে আহাদিসিল হিদায়া]


৫৬. কুরআন স্পর্শ করা ও অন্যান্য বিষয়ে ফরমান: অপবিত্র অবস্থায় আল-কুরআন স্পর্শ করা যায় না, কুরআন মাজীদ কেবল পাক- পবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করা যায়। স্বামী হওয়ার আগে কেউ তালাক দিলে সে তালাক হয় না। ক্রয় করার আগে কোনো গোলামকে মুক্ত করা যায় না । এ জাতীয় বিভিন্ন বিধান লিখে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়েমেনবাসীর জন্য আরেকখানা ফরমান প্রেরণ করেন ।

৫৭. দিয়ত বিষয়ক ফরমান: কেউ অন্যায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হলে সে জন্য কিসাস বা দিয়াতের ব্যবস্থা রয়েছে। ভুলক্রমে হত্যার ক্ষেত্রেও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। আরবের লোকেরা এতে অভ্যস্ত ছিল না। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তাই লিখিতভাবে আরবের প্রতিটি কবিলার কাছে দিয়ত বিষয়ক ফরমান পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। [সূত্র : সহিহ বুখারী]

৫৮. খায়বরের ভূমিবণ্টন চুক্তি: খায়বর ঐতিহাসিকভাবে ইহুদিদের অধিকারভুক্ত অঞ্চল ছিল। এখানে তারা একটি দুর্গও গড়ে তুলেছিল। হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) খায়বরে অভিযানের পর ইহুদিরা পরাজয় শিকার করতে বাধ্য হয়। পুরো এলাকা হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর অধিকারভুক্ত হয়। তা সত্ত্বেও তিনি ইহুদিদের সাথে দখলকৃত জমি বণ্টনের চুক্তিপত্র সম্পন্ন করেন এবং চুক্তিপত্রটি লিখিত আকারে ইহুদিদের দিয়ে দেন।

৫৯. হামাদান গোত্রের প্রতি পত্র: হযরত আলী (রা.)-এর মাধ্যমে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হামাদান গোত্রের প্রতি একখানা পত্র প্রেরণ করেন।

হাফিজ ইবনে কাসীর (রহ.) লিখেছেন-
‘হযরত আলী (রা.) তাদেরকে এ পত্র পাঠ করে শোনালে তাদের সকলে একসঙ্গে ইসলাম গ্রহণ করেন।’
[সূত্র : আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া]


৬০. জুররা ও আযরাহবাসীর জন্য নিরাপত্তানামা: জুররা ও আযরাহবাসীদের নামে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) একখানা নিরাপত্তানামা লিখে পাঠান। হাফির ইবনে কাসির (রহ.) এ নিরাপত্তানামার কিছু অংশ নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণনাও করেন।

৬১. হিময়ারের বাদশাহর প্রতি পত্র: হাফিজ ইবনে কাসীর (রহ.) উল্লেখ করেন, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিময়ারের বাদশাহের নিকটও ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে একখানা পত্র প্রেরণ করেন।

৬২. নাজরানের বিশপ পাদ্রীকে পত্র: নাজরানের বিশপ পাদ্রীর নামে লিখিত এক পত্রে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আল্লাহ তায়ালার নবি ও রাসূল মুহাম্মদের পক্ষ থেকে নাজরানের খ্রিস্টান নেতা বিশেপের প্রতি এ পত্র । আপনি ইসলাম গ্রহণ করুন। আমি আপনার নিকট ইব্রাহীম, ইসহাক ও ইয়াকুব প্রমুখ নবিগণের রব আল্লাহ তায়ালার প্রশংসা করছি। এরপর আমি আপনাদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে এক আল্লাহ তা’য়ালার দাসত্ব কবুল করার এবং মানুষের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করে আল্লাহ তায়ালার বন্ধুত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতার আশ্রয় গ্রহণের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। এ আহ্বান কবুল না করলে আপনারা জিযিয়া দিতে বাধ্য থাকবেন। আর জিযিয়া দিতে অস্বীকার করলে তরবারি ও যুদ্ধ আপনাদের ব্যাপারে ফায়সালা করবে।

৬৩. ইবনে জাসমকে ফরমান: হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হিজরি দশন সনে তাঁর ইন্তিকালের আগে হযরত আমর ইবনে জাযমকে নাজরানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তখন হযরত আমর (রা.) নবিকে সাদকা, দিয়ত, ফরজ-সুন্নাহ প্রভৃতি বিষয় সম্পৰ্কীয় একটি বিস্তারিত দলিল লিখে দেন। [সূত্র : কিতাবুল আমওয়াল]

৬৪. সাদাকা ও যাকাতবিষয়ক সংকলন: ইন্তিকালের কিছুদিন আগে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) সাদাকা ও যাকাতবিষয়ক একখানা পরিপূর্ণ গাইডলাইন তৈরি করেন। এটি তিনি মুসলিম জাহানের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করার ইচ্ছায় সংকলন করেন। ইতোমধ্যে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তিকাল করেন। ফলে সংকলনখানা মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়নি।
এ গাইড লাইন মেনে সাহাবিগণ তাদের জীবন পরিচালনা করতেন। শাসকগণ শাসনকাজে একান্তভাবে তাঁকে অনুসরণ শুরু করেন। উমাইয়া শাসক আব্দুলাহর ইবনে আজীজ হাদিসের অন্যান্য সংকলনের মতো এ জাতীয় সংকলনের আগ্রহ দেখান। তাঁর চেষ্টায় হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ব্যবস্থাপনায় লিখিত সাদাকা ও যাকাতবিষয়ক হাদিসগুলো পূর্ণভাবে সংরক্ষিত হয়।

৬৫. লিখে রাখার আগ্রহ: হযরত হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে হাদিসসমূহ লিখে রাখার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছেন। এমনকি মৃত্যুশয্যায় শুয়েও তিনি কিছু লিখে রাখার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শারীরিক অবস্থা ও যন্ত্রণার জন্য হযরত উমর (রা.) কাগজ দেননি। অবশ্য এরপর হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন সুস্থ তখন আর তিনি নতুন করে কিছু লিখার আগ্রহ দেখাননি।

প্রকৃতপক্ষে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় এ রকম অসংখ্য বিষয়ে চিঠি লিখা হয়েছে, ফরমান জারি করা হয়েছে, ইসলাম গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে, মুসলিমদেরকে লিখে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করা হয়েছে, আর এই লিখিত বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোত্র বা গোষ্ঠী সংরক্ষণ করেছে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সকল ক্ষেত্রে এর অভিন্ন রূপ দেখা গিয়েছে। মিফতাহুল আখবার গ্রন্থে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর ৩৬ খানা চিঠির অনুলিপি উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো গবেষক হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশনায় লিখিত এ রকম প্রায় আড়াইশত চিঠি বা ফরমানের উল্লেখ করেছেন। তাই রাসূল যুগে হাদিস গ্রন্থাবদ্ধ না হলেও লিখে সংরক্ষণের ধারা যে অত্যন্ত প্রবলভাবেই বিদ্যমান ছিল তা এ সকল উদ্যোগ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় ।


হাদিস সম্পর্কে আরো জানতে যোগাযোগ করুণ আমাদের ইমেইলে-
ইমেইলadmin@biratbazar.com

 

নতুন নতুন আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের ইউটিউব এবং সোশ্যাল চ্যানেলে-
ইউটিউব – https://www.youtube.com/@BiratBazar
ফেইসবুক – https://www.facebook.com/BiratBazarOfficial
→ টুইটার – https://twitter.com/BiratBazar
→ ইন্সটাগ্রাম – https://www.instagram.com/biratbazar/
থ্রেডস – https://www.threads.net/@biratbazar
লিংকড ইন – https://www.linkedin.com/company/biratbazar

 

মুসলিমতত্ত্ব সম্পর্কিত অন্যান্য পোস্টসমূহ-
৪। মানুষ কেন লোভী হয়?

 

Leave a Comment

Recent Posts

মালনীছড়া চা বাগান

উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রাচীন প্রতিষ্ঠিত ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া বাংলাদেশের সিলেট সদর উপজেলার ৩নং খাদিম নগর ইউনিয়নের এয়ারপোর্ট রোডে… Read More

1 month ago

Malnicherra Tea Garden

The Malnicherra Tea Garden, the oldest and largest established tea plantation in the Indian subcontinent, is located on the outskirts… Read More

1 month ago

হযরত শাহজালাল রহ.

শাহ জালাল (রাহ.) বাংলার একজন প্রখ্যাত সুফি দরবেশ। শুধু বাংলার নয়, সম্পূর্ণ পাক-ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি বিখ্যাত। পুরো নাম শাহ জালাল… Read More

2 months ago

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবান জেলার প্রবেশ পথে (বান্দরবান-কেরাণীহাট) সড়কের পাশে পার্বত্য জেলা পরিষদ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এটি বান্দরবান শহর থেকে… Read More

3 months ago

Meghla Tourism Complex

Meghla Tourism Complex is located at the entrance of Bandarban district, along the Bandarban-Keranihat road, adjacent to the Hill District… Read More

3 months ago

বাকলাই জলপ্রপাত

বাকলাই জলপ্রপাত বাংলাদেশের বান্দরবন জেলার থানচি উপজেলার নাইটিং মৌজার বাকলাই গ্রামে অবস্থিত। স্থানীয়দের নিকট “বাক্তলাই ঝর্ণা” নামেও পরিচিত। মুলত কেওক্রাডং… Read More

3 months ago